দেশজুড়ে

বছর বছর বন্যা যেন সুনামগঞ্জবাসীর নিয়তি

হাওরের জেলা সুনামগঞ্জ। বছরের ছয়মাস শুকনা এবং ছয়মাস জলমগ্ন থাকে এই জেলা। তবে এখানকার মানুষের কাছে বন্যা এখন আর আকস্মিক দুর্যোগ নয়—যেন নিয়তি। জীবিকার জন্য যারা প্রধানত কৃষির ওপর নির্ভরশীল, তাদের ভাগ্য প্রতিনিয়ত বৈরী আবহাওয়ার করুণার ওপর ঝুলে থাকে। যখন বোরো ধান ঘরে তোলার সময় আসে, ঠিক তখনই পাহাড়ি ঢল আর অতিবৃষ্টি এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কৃষকের সব স্বপ্ন।

আতঙ্কের নাম বন্যা

সুনামগঞ্জের ইতিহাসে ২০১৭ ও ২০২২ সাল বিশেষভাবে আতঙ্কের। এই দুই বছরের ভয়াবহতা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত দিয়েছে হাওরবাসীকে। ২০১৭ সালের এপ্রিলে উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও বৃষ্টিতে ১৫৪টি হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে যায়। প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বোরো ধান তলিয়ে যায়। ডুবে যাওয়া ধানক্ষেতের কীটনাশক পানিতে মিশে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে, যার ফলে মরে ভেসে ওঠে শতকোটি টাকার মাছ। বন্যায় ৩৩২ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা মেরামত করতে প্রয়োজন হয় ২৩৫ কোটি টাকা।

২০১৭ সালের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই ২০২২ সালের ১৬ জুন আরেকটি ভয়াবহ বন্যা আসে। এক রাতের মধ্যে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সব তলিয়ে যায়। বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পুরো জেলা। এই বন্যায় মানুষের ঘরবাড়ির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়, যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ৪৫ হাজার ২৮৮টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া ২৫ হাজার ২০৪টি পুকুরের মাছ ভেসে যায়। মারা যায় এক হাজার ৬৪২টি গবাদিপশু।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৃষ্টিতে সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ নেই। মূলত ভারতের চেরাপুঞ্জিতে অতিভারী বৃষ্টিপাত শুরু হলে পাহাড়ি ঢল নামে। এতে জেলার সুরমা, কুশিয়ারা, যাদুকাটাসহ ২৬টি নদীর পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। বন্যার আরেকটি কারণ নদী ভরাট ও নাব্য সংকট।

আরও পড়ুন: ১০ বছরে হাওরে পরিযায়ী পাখি কমেছে ৮৫ শতাংশটাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য-মাছ রক্ষায় কাজ করবে সরকারটাঙ্গুয়ার হাওরে হাত বাড়ালেই মাদক পাচ্ছেন পর্যটকরা

সুনামগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সহ-সভাপতি আইনজীবী খলিলুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‌‘বছর বছর পাহাড়ি ঢলে ফসলহানি ও জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই সমস্যার মূল কারণ নদী ভরাট সমস্যার সমাধানে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।নদীর গভীরতা ও নাব্য সৃষ্টিতে নদী খনন-ড্রেজিংয়ের বিকল্প নেই। এভাবে নদী গভীর ও নাব্য হলে বর্ষার শেষে হাওরের পানি দ্রুত সরে যাওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হবে।’

সুনামগঞ্জের হাওর বিশেষজ্ঞ ওয়াবায়দুল হক মিলনের মতে, অকাল বন্যায় হাওরাঞ্চলে ফসলের ভয়াবহ ক্ষতি হয়। ফলে বছরব্যাপী খাদ্যাভাব, পশুখাদ্যের অভাবে পড়ে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। আগাম বন্যার কারণে বাড়িঘর রক্ষায় প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পাওয়া যায় না। আবার বর্ষায় বাড়িঘর বিধ্বস্ত হওয়ার মুখোমুখি হতে হয়। এগুলো প্রতিবছর বেড়েই চলেছে।

সুনামগঞ্জ হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিবছর বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এই ক্ষতিটা যাতে কৃষকরা কাটিয়ে উঠতে পারেন, সেজন্য কৃষিঋণ মওকুফ করা এবং প্রতি মৌসুমে বিনা সুদে কৃষিঋণ বিতরণের নিশ্চয়তা বিধান করার দরকার।’

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, এই জেলায় বন্যা হবেই। সেটা আটকানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। তবে মোকাবিলা করার ক্ষমতা আছে। ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

এসআর/জেআইএম