বিশাল আকাশের মাঝে সাদা মেঘের ভেলা প্রায় ফিকে হবার পথে। নদী তীরে যে শুভ্র কাশফুল এক মাস ধরে আনন্দের পতাকা উড়িয়েছিল, তার যৌবনও আজ শেষের পথে। ক্যালেন্ডারে চলছে বাংলার ঋতুরানি শরৎকালের বিদায়বেলা। এই বিদায়মেলায় রাজধানীর বুকে চলছে ‘বিসিক শরৎ মেলা’। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) পাঁচ দিনব্যাপী শরৎ মেলার আয়োজন করেছে। মেলায় মাটির গহনা, নকশি কাঁথা কিংবা কাঠের তৈরি ঐতিহ্যবাহী পণ্যের বিশাল সমাহার একদিকে যেমন দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে, তেমনি ক্রেতাদের আগ্রহও বাড়িয়ে তুলছে।
মেলায় রয়েছে নকশি কাঁথা, শতরঞ্জি, হস্ত ও কারুশিল্প, পাটজাত, বাঁশ-বেত, চামড়াজাত, গহনা, মৃৎশিল্প এবং বস্ত্র খাতের নানান রকম পণ্য। ৪০ জন উদ্যোক্তা এসব বাহারি পণ্য নিয়ে মেলায় এসেছেন। এতে মোট স্টল সংখ্যা ৪৩টি। এরমধ্যে উদ্যোক্তাদের জন্য ৪০টি, বিসিক নকশা কেন্দ্রের জন্য ২টি এবং নকশা কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্যোক্তাদের জন্য ১টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। রোববার সকাল থেকে এই মেলা শুরু হয়েছে।
হাতের কারুকাজ, গহনা ও প্রসাধনী সাজিয়ে উদ্যোক্তারা বসে আছেন ক্রেতাদের অপেক্ষায়। ট্রেন্ডিং সব ডিজাইনের পণ্য কিনতে দর্শনাথী ও ক্রেতারা ভিড় করছেন স্টলগুলোতে। ৫০ টাকা থেকে শুরু করে কয়েক হাজার টাকার পণ্য পাওয়া যাচ্ছে মেলায়। কিছু কিছু পণ্যে রয়েছে আকর্ষণীয় অফার। প্রতিটি পণ্যই বাইরের দামের তুলনায় কমে বিক্রি করা হচ্ছে।
হেপি ইসলাম তালুকদার নামে এক উদ্যোক্তা যাত্রাবাড়ি থেকে এসেছেন। তিনি পাট এবং পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি হস্তশিল্প নিয়ে এসেছেন। তার পণ্য প্রতিষ্ঠানে পাটের তৈরি ঝুড়ি, বাক্স, প্লেট, ম্যাট, হ্যান্ডব্যাগ এবং ওয়াল হ্যাংগিং রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে নকশা করা কিছু সাজসজ্জাও। তিনি বলেন, ‘আমি একবছর যাবত এই শিল্পে আছি। আমাদের পণ্যের বিশেষত্ব হলো-এগুলো পরিবেশবান্ধব পণ্য।’ মেলায় বেচাবিক্রি কেমন চলছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আজ মেলার তৃতীয় দিন। গতকালের চেয়ে আজ মেলায় বিক্রি বেশি। আরও দুইদিন চলবে মেলা। অনেকে হয়তো সামনের দিনগুলোতে কিনবে। আমাদের উদ্যোক্তাদের পণ্যগুলো মানুষের মাঝে পৌঁছে দিতে মেলা অনেক বড় প্ল্যাটফর্ম। এজন্য বিসিক কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ।’
ফাহমিদা খাতুন লুবনা মিরপুর কাজীপাড়া থাকেন। তিনি কাঠের পণ্য নিয়ে কাজ করেন। বছর দুয়েক হবে ক্রাফটিং নিয়ে কাজ শুরু করছেন। জানতে চাইলাম, আপনার পণ্য ক্রেতারা পছন্দের তালিকায় রাখবে কেন? সাদামাটা উত্তর, ‘আমার পণ্যগুলো কাঠের তৈরি দেশীয় পণ্য। মানুষের কাছে পণ্যগুলো সহজলভ্য করতে চাচ্ছি। এখন মানুষ দিনদিন সৌখিন হচ্ছেন। ঘর পরিপাটি করে সাজাতে চান। সেক্ষেত্রে আমাদের পণ্যগুলো কাজে দেবে।’
স্টল পাওয়া নিয়ে বিসিকের সহযোগিতা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে ফাহমিদা খাতুন লুবনা বলেন, ‘আমি বিসিকের সদস্য। তাই স্টলের ভাড়াটা একটু কম পড়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন পত্রিকা ও চ্যানেলে আমার পণ্যের মার্কেটিং হচ্ছে। পুরো বিষয়টা নিয়ে বিসিক সাহায্য করেছে।’ তার পণ্য প্রতিষ্ঠানের নাম ‘ইনভেন্ট ক্রাফটস’। কাঠের তৈরি এসব পণ্য পাওয়া যাচ্ছে ১০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকার মধ্যে। প্রতিষ্ঠানটি কাঠের কলম, চিরুনি, পলিথিন হোল্ডার, হ্যাঙ্গার, চাবির রিং ও শিশুদের খেলনাসহ নানা পণ্য নিয়ে মেলায় এসেছে।
ফায়েজ আহমেদ নামে একজন বিক্রেতার সঙ্গে কথা হয়। তিনি ‘বিএক্সএল ফুটওয়ার’ নামে চামড়াজাত পণ্য নিয়ে প্রদর্শনী ও বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছেন। স্টলটিতে চোখে পড়ে ছেলেদের বিভিন্ন রকমের জুতা, ব্যাগ, বেল্ট এবং মানিব্যাগ। বাজারে অনেক ধরনের চামড়াজাত পণ্য পাওয়া যায় আপনাদেরটাই কিনবে কেন? তিনি জানান, ‘আমরা সবসময় অথেনটিক প্রোডাক্ট দেওয়ার চেষ্টা করি। এখানে কপি বা আর্টিফিশিয়াল লেদার নেই। সবটাই অর্জিনাল, চামড়াজাত পণ্য। পুরো প্রসেসটা নিজেরা করে থাকি। তাছাড়া বেসিক থেকে আমাদের প্রোডাক্টের মানের উন্নতিতে ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে সহযোগিতা করা হয়।’
সময়টা তখন দুপুরের প্রহর গড়িয়ে বিকেলে পা রাখছে। বিসিকের নিচতলায় দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের চাপ বাড়ছে। মেলায় শিশু, তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে মধ্যবয়সীদেরও দেখা মিলছে। বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে এসেছেন শিক্ষার্থীরা। কেউ আসছেন অফিসের কাজের শেষে। তবে নারীদের উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি। সবাই ঘর সাজাতে ও চাহিদা অনুযায়ী পণ্য কিনতে ঘুরে দেখার পাশাপাশি দরদাম করছেন। কেউ আবার মোবাইলের ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি হচ্ছেন।
ঢাকার ফার্মগেট থেকে শাহিনা আক্তার তার পাঁচ বছরের সন্তান সাজেদ ইসলাম উমরকে নিয়ে মেলায় এসেছেন। জানতে চাইলাম মেলা কেমন দেখছেন? তার সন্তানকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘ওকে নিয়ে আসলাম। ঘুরে ঘুরে দেখছি কিছু নেওয়া যায় কি না। পছন্দ হলেই কিনব।’
মো. বশির হোসেন এসেছেন তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা থেকে। হাতে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে চলছেন। বললাম ব্যাগে কি? ‘ব্যাগে এক জোড়া চামড়ার জুতা। ১২০০ টাকা দিয়ে নিলাম। কাল বউকে নিয়ে আসব, সেও কিছু কেনাকাটা করবে।’ একগাল হেসেই বলছিলেন তিনি।
বিসিক শরৎ মেলা চলবে আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। মেলায় নির্ধারিত কোনো প্রবেশ মূল্য নেই। বিসিকের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, বিসিক নকশা কেন্দ্র ও বিসিকের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্যোক্তাদের তৈরি পণ্যসামগ্রীর পরিচিতি, বিপণন এবং বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রতিবছরই বিসিক এ ধরনের মেলার আয়োজন করে থাকে।
আরও পড়ুনঠান্ডার সঙ্গে যুদ্ধ যেখানে, নাক হারাতে বসেছিলেন রুহি চেনেটআজকের কন্যাশিশু ভবিষ্যতের নোবেল বিজয়ী
কেএসকে/এএসএম