রাজনীতি

ক্ষমতায় গেলে দেশের স্বার্থকে সবার আগে রাখবে বিএনপি

আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অংশীদারদের সঙ্গে ধারাবাহিক যোগাযোগকে প্রয়োজনীয় ও স্বাভাবিক মনে করে বিএনপি। ক্ষমতায় গেলে বিএনপি দেশের স্বার্থকে সবার আগে রাখবে বলে জানিয়েছেন দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম।

তিনি বলেছেন, বিএনপি বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা গড়ে তুলবে সমতার ভিত্তিতে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিল ভারসাম্য রক্ষা করবে।

জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক খালিদ হোসেন। আজ থাকছে প্রথম পর্ব।

জাগো নিউজ: সম্প্রতি বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে ধারাবাহিক যোগাযোগ রাখছে বিএনপি। এর উদ্দেশ্য বা বার্তা কী?

নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম: দেখুন, আমরা এখন গ্লোবাল ভিলেজে বাস করি। বাংলাদেশ বা বিএনপি— কেউই এই বৈশ্বিক পরিমণ্ডলের বাইরে নয়। আমাদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, ইউএনডিপি, এমনকি পূর্ব ও পশ্চিমের বহু দেশ— এরা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী। প্রত্যেকটি দেশই রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়েই এগিয়ে যায়।

সেই জায়গা থেকেই বিএনপির সঙ্গে বৈশ্বিক অংশীদারদের যোগাযোগ থাকা খুবই স্বাভাবিক। তারা জানতে চান— বিএনপি যদি কখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে, তাহলে দেশ পরিচালনায় কী নীতি অবলম্বন করবে, উন্নয়ন ও গণতন্ত্র নিয়ে কী রোডম্যাপ রাখবে। বিএনপিও তাদের জানাতে চায়— আমরা কীভাবে জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করবো।

আরও পড়ুনজাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট করলে ‘আম-ছালা দুইটাই যাবে’: ডা. তাহেরকোনো দুর্নীতিবাজ-সন্ত্রাসী বিএনপির সদস্য হতে পারবে না: রিজভীদেশে ফিরে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেবেন তারেক রহমানপিআর পদ্ধতিতে ভোটে জনগণের ক্ষমতা খর্ব হবে: ফখরুল

বিএনপি জনগণের দল, জনগণের বাইরে আমাদের কোনো চিন্তা নেই। তবে জনগণের কল্যাণে কাজ করতে গেলে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সহযোগিতা দরকার। উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সেই সহযোগিতার মাধ্যমেই আসে।

জাগো নিউজ: তাহলে কি বলা যায়—এটা নির্বাচনের আগে বিএনপির কূটনৈতিক রণকৌশলের অংশ?

নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম: না, এটা কূটনৈতিক রণকৌশল নয়, বরং বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রক্রিয়া। বিএনপি অতীতেও রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। ভুল-ত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা এখন আরও পরিণত। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেও বলেছেন— অতীতের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা শিখেছি।

বিশ্ব এখন প্রতিযোগিতার যুগে। জ্ঞান, শিক্ষা ও সহযোগিতা বিনিময় ছাড়া টিকে থাকা যায় না। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে আমাদের শিক্ষার্থীরা বিদেশে গিয়ে জ্ঞান অর্জন করছে— এটাও পারস্পরিক সহযোগিতারই অংশ। তাই কূটনৈতিক যোগাযোগকে আমি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় মনে করি।

জাগো নিউজ: পশ্চিমা বিশ্ব এখন বাংলাদেশের নির্বাচনে কতটা আগ্রহী বলে আপনি মনে করেন?

নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম: আমি নিঃসন্দেহে বলব— তারা সবসময় আগ্রহী ছিলেন, এখনো আছেন। পৃথিবীর সব গণতন্ত্রকামী দেশই চায়—অন্য দেশেও গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হোক।

বাংলাদেশে ইউএনডিপি, ইউএসএইড কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো উন্নয়ন সহযোগীরা বহু বছর ধরে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশে কাজ করছে। এমনকি গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনামলেও তারা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করেছে— কারণ গণতন্ত্রে সব পক্ষের অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। তাই তারা নিশ্চয়ই চায়, বাংলাদেশে নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক।

জাগো নিউজ: নির্বাচনের আগে কি আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা বা সংলাপের কোনো উদ্যোগ আসতে পারে?

নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম: এ বিষয়ে আমি নির্দিষ্ট কিছু বলতে পারবো না। আমাদের দলের শীর্ষ নেতৃত্ব— মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। যদি আন্তর্জাতিক মহল থেকে কোনো প্রস্তাব আসে, তারা সেটি বিবেচনা করবেন।

আরও পড়ুন১৭ বছর আন্দোলন করেছি বাসস্ট্যান্ড দখলের জন্য নয়: ইশরাক‘কে কে পিআর বোঝেন?’ ফখরুলের প্রশ্নে সমমনা জোটনেতাদের নাতারেক রহমান বাংলাদেশে নারীর সর্বোচ্চ ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবেনবিএনপির ৩১ দফাই আধুনিক বাংলাদেশের রূপরেখা: মনিরুল হক চৌধুরী

জাগো নিউজ: ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক আপনি কীভাবে দেখছেন? দিল্লির সাম্প্রতিক অবস্থানকে বিএনপি কীভাবে ব্যাখ্যা করছে?

নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম: আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে খুব স্পষ্টভাবে বলেছেন—ভারতই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন হবে।

যদি ভারত বাংলাদেশের জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে জনগণের প্রতিক্রিয়াও সমানভাবে ফিরে আসবে— এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। বিএনপি সবসময় জনগণের অনুভূতিকে ধারণ করেই রাজনীতি করে এবং ভবিষ্যতের কর্মপন্থাও সেই অনুযায়ী নির্ধারিত হবে।

জাগো নিউজ: সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপূজায় বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার বিকৃত মূর্তি বা অসুরের রূপ তৈরি করা হয়েছে। এটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে কী বার্তা দেয় বলে আপনি মনে করেন?

নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম: এটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত নিন্দনীয়। ধর্মীয় উৎসব হোক বা অন্য কিছু—কোনো দেশের প্রধান বা শীর্ষ নেতৃত্বকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়।

আপনি যেমন বললেন, এটি পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছে—কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এটাকে নিবারণ বা অনুৎসাহিত করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি, সেটা আরও দুঃখজনক। এর মানে দাঁড়ায়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এক ধরনের নীরব সম্মতি ছিল। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে এটা অত্যন্ত নেতিবাচক বার্তা দেয়—যেন প্রতিবেশী বাংলাদেশকে তারা অবজ্ঞার চোখে দেখছে।

একটি দেশ যখন অন্য দেশের নেতৃত্ব বা জনগণের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ প্রকাশ করে, সেটা কেবল সাংস্কৃতিক নয়, কূটনৈতিকভাবেও সম্পর্কের ক্ষতি ডেকে আনে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড আঞ্চলিক সৌহার্দ্যের পরিপন্থি।

জাগো নিউজ: আপনি তো নিজেই বলেছেন—বিএনপি গত ১৬ বছর ধরে যে নির্যাতনের মুখে আছে, সেটা আংশিকভাবে ভারতের রাজনৈতিক সহায়তায়ই সম্ভব হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন—আপনারা যদি ক্ষমতায় যান, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ভারত ও চীনের মধ্যে কাকে কতটা গুরুত্ব দেবেন?

নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম: দেখুন, রাজনীতি ও কূটনীতি—এটা একটা শিল্প, একটা ডিপ্লোমেটিক আর্ট। এখানে দক্ষতা হলো—আপনি এক দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখবেন কিন্তু অন্য দেশকে অপমান না করে। এই ভারসাম্যটাই আসল প্রজ্ঞা।

আরও পড়ুনসংস্কারের মধ্যে দিয়েই বিএনপির জন্ম : মির্জা ফখরুলপ্রত্যেক মেয়ের স্বপ্ন পূরণে রাষ্ট্রকে সঙ্গী করবো: তারেক রহমানদল অনুগত প্রশাসন দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না: রিজভীএকটি দল ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ভোট চাচ্ছে: এ্যানি

ভারত ও চীন—দুজনেরই গ্লোবাল পলিটিক্সে স্বার্থ আলাদা। ভারতের মধ্যে একটি আধিপত্যবাদী মনোভাব কাজ করে, তারা দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চায়। অন্যদিকে চীন বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে তোলে। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ তার বড় উদাহরণ।

এখানে শুধু ভারত বা চীন নয়, আমেরিকারও একটি ভূ-রাজনৈতিক আগ্রহ আছে। এই জটিল বাস্তবতায় একটি বুদ্ধিদীপ্ত ভারসাম্য রক্ষা করাই হলো রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্ব। বিএনপি সেই ভারসাম্য রক্ষায় বিশ্বাস করে।

আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সবসময় বলেন, বিদেশে আমাদের বন্ধু থাকবে, প্রভু নয়। এটাই বিএনপির পররাষ্ট্রনীতির সারকথা। আমাদের সম্পর্ক হবে সমতার ভিত্তিতে, কোনো আত্মসমর্পণ নয়।

জাগো নিউজ: তাহলে বিএনপির পররাষ্ট্রনীতির মূল দর্শন কী হবে?

নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম: একটি শব্দে বললে—সবার আগে বাংলাদেশ। এটা কোনো আমদানি করা ধারণা নয়। অনেকে বলেন, এটা নাকি ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’র মতো। কিন্তু বাস্তবে তারেক রহমান বহু আগেই বলেছেন— সবার আগে বাংলাদেশের স্বার্থ, বাংলাদেশের জনগণ।

আরও পড়ুনরাজনৈতিক দলগুলোর সিস্টেম পরিবর্তনের প্রয়োজন: আমীর খসরুউপদেষ্টাদের সেফ এক্সিটের কথা ভাবা স্বাভাবিক: শামসুজ্জামান দুদুদেশ পরিচালনার যোগ্যতা একমাত্র বিএনপিরই রয়েছে: প্রিন্সনিজেদের স্বার্থরক্ষায় ভারত সবসময় বাংলাদেশকে ব্যবহার করেছে: দুদু

আমাদের অবস্থান খুব পরিষ্কার, বাংলাদেশের সার্বভৌম স্বার্থের সঙ্গে কারও বন্ধুত্ব বা সহযোগিতা সাংঘর্ষিক হলে সেটা মেনে নেওয়া হবে না।

চীন, ভারত, আমেরিকা—সবাই বাংলাদেশের মঙ্গল চায়, এটাই আমরা ধরে নিতে চাই। কিন্তু কাউকেই আমরা ‘প্রভু’ হিসেবে দেখি না।

কেএইচ/এমএমএআর/এমএফএ/এমএস