গাজা নিয়ন্ত্রণে হামাসকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে বেশ কিছু সশস্ত্র গোত্র ও গোষ্ঠী। অবরুদ্ধ উপত্যকাটিতে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হামাসের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সেই সুযোগে গাজার অভ্যন্তরে নানা সশস্ত্র গোষ্ঠী ও স্থানীয় প্রভাবশালী গোত্র হামাসের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করে।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর হামাস ফের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘অস্থায়ীভাবে নিরাপত্তা রক্ষার অনুমোদন’ পাওয়ার পর গাজা উপত্যকায় কঠোর অভিযানে ডজনখানেক প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যা করে।
নিচে গত দুই বছরে হামাসের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গোত্র ও গোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করা হলো—
আবু শাবাব গোত্ররাফাহ এলাকার ইয়াসের আবু শাবাব হামাসবিরোধী সবচেয়ে প্রভাবশালী গোত্রনেতা। তিনি দক্ষিণ গাজার সেই অংশে কার্যক্রম চালান, যা এখনো ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আবু শাবাবের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, তিনি আকর্ষণীয় বেতনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শত শত যোদ্ধা নিয়োগ দিয়েছেন।
আরও পড়ুন>>শান্তি প্রস্তাব মানলেও অস্ত্র জমা দেবে না হামাসহামাস অস্ত্র জমা না দিলে জোর করে নিরস্ত্র করবো: ট্রাম্পইসরায়েলের সব জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস
হামাস অভিযোগ করেছে, আবু শাবাবের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক রয়েছে। তবে এই অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেছেন।
তার গোত্র মূলত রাফাহর পূর্বাঞ্চলকেন্দ্রিক এক বেদুইন সম্প্রদায়। পুরো গোত্র তার কর্মকাণ্ডে একমত কি না, তা স্পষ্ট নয়। আবু শাবাবের নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যসংখ্যা প্রায় ৪০০ বলে ধারণা করা হয়।
দোগমোশ গোত্রগাজা উপত্যকার অন্যতম বৃহৎ ও শক্তিশালী গোত্র দোগমোশ। ঐতিহাসিকভাবে এ গোত্রের সদস্যরা ভালোভাবে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। গোত্রনেতাদের মতে, ভূমি রক্ষার জন্য অস্ত্রধারণ তাদের সংস্কৃতিরই অংশ। তাদের সদস্যরা ফাতাহ ও হামাসসহ বিভিন্ন ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।
মুমতাজ দোগমোশ এ গোত্রের প্রধান নেতাদের একজন। তিনি একসময় গাজা সিটিতে ‘পপুলার রেজিস্ট্যান্স কমিটি’র সশস্ত্র শাখার নেতৃত্ব দিতেন। পরবর্তীতে তিনি গঠন করেন ‘আর্মি অব ইসলাম’, যা আইএস বা ইসলামিক স্টেটের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে। এই সংগঠনটি ২০০৬ সালে হামাসের সঙ্গে মিলে ইসরায়েলি সেনা গিলাদ শালিতকে আটক করার ঘটনায় জড়িত ছিল। পরে বন্দি বিনিময়ে শালিতকে মুক্তি দেওয়া হয়।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ থেকেই মুমতাজ দোগমোশের অবস্থান অজানা। অতীতে হামাসের সঙ্গে এ গোত্রের সংঘর্ষ হয়েছে, কারণ তারা নিরস্ত্র হতে অস্বীকার করেছিল এবং আর্মি অব ইসলাম এক ব্রিটিশ সাংবাদিককে অপহরণ করেছিল।
চলতি সপ্তাহে রোববার ও সোমবার হামাস যোদ্ধাদের সঙ্গে দোগমোশ গোত্রের সংঘর্ষ হয়। এতে উভয় পক্ষের বহু সদস্য নিহত হন। নিরাপত্তা সূত্র বলছে, মুমতাজ দোগমোশ এ সংঘর্ষে ছিলেন না। কারণ কয়েক বছর ধরে তাকে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
আল-মাজায়দা গোত্রগাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস শহরকেন্দ্রিক বৃহৎ ও প্রভাবশালী এই গোত্রের সদস্যরাও সাম্প্রতিক মাসগুলোতে হামাসের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে।
চলতি মাসের শুরুতে হামাস এই এলাকায় অভিযান চালায়। তাদের দাবি, হামাস সদস্য হত্যার দায়ে অভিযুক্ত কয়েকজনকে গ্রেফতার করার জন্য ওই অভিযান চালানো হয়। এসময় বন্দুকযুদ্ধ শুরু হলে হামাস ও গোত্রের উভয় পক্ষেই কয়েকজন নিহত হন।
গোত্রের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো হামাসের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা আবু শাবাবের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না। বরং হামাসের বিরুদ্ধে তারা ‘টার্গেট কিলিংয়ের অজুহাত হিসেবে অভিযান চালানোর’ অভিযোগ করেছে। গোত্রনেতারা দাবি করেছেন, নিহত হামাস যোদ্ধাদের দেহ থেকে উদ্ধার করা এক নথি এর প্রমাণ দেয়।
তবে সোমবার গোত্রপ্রধান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে গাজায় আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হামাসের ‘নিরাপত্তা অভিযান’-এর প্রতি সমর্থন ও সবাইকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। এই গোত্রের সদস্যদের মধ্যে ফাতাহ ও হামাস—উভয় দলের সমর্থকই রয়েছে।
রামি হেলিসহেলিস গোত্র গাজা সিটির অন্যতম বৃহৎ পরিবার, যাদের মূল কেন্দ্র শেজায়িয়া উপশহরে। কয়েক মাস আগে গোত্রের জ্যেষ্ঠ সদস্য রামি হেলিস ও একই এলাকার আহমেদ জুনদেয়া মিলে হামাসবিরোধী একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী গঠন করেন। তারা শেজায়িয়ার সেই অংশে সক্রিয়, যা এখনো ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
সার্বিকভাবে, গাজার ভেতরে হামাসের নিয়ন্ত্রণ এখন একাধিক স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠী ও গোত্রীয় শক্তির চাপে নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। যুদ্ধবিরতির পরও গাজার অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এভাবে বাড়তে থাকলে, সেখানে হামাসের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
সূত্র: রয়টার্সকেএএ/