দেশজুড়ে

হোটেলে খাবার নষ্ট কম, ৫ গুণ বেশি দাওয়াতে

‘হোটেলে মাছের কাঁটাটাও চেটে-পুটে খায়, কিন্তু অনুষ্ঠানে রোস্টে এক কামড় বসিয়েই ফেলে দেয়’—খাবার নষ্টের উদাহরণ দিতে গিয়ে ক্যাটারার্স সার্ভিসের সদস্য হারুন অর রশিদ এই উদাহরণ টানলেন।

অন্যদিকে, হোটেল কর্মচারী আনোয়ার হোসেনের ভাষ্য, ‘গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে হোটেলে খেতে এসেছে। একসঙ্গে চার-পাঁচ আইটেম অর্ডার দিয়ে অর্ধেক খেয়ে অর্ধেক নষ্ট করে চলে যাচ্ছে। ভাবখানা এমন, টাকা থাকলেই যা খুশি করা যায়।’ এই দুই বক্তব্যেই হোটেল-রেস্তোরাঁ ও অনুষ্ঠানে খাবার নষ্টের চিত্র উঠে এসেছে।

যশোরের হোটেল-রেস্তোরাঁয় ২-৩ শতাংশ খাবার নষ্ট হলেও অনুষ্ঠানে অন্তত ১০ শতাংশ খাবার নষ্ট হয়। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এই চিত্র উঠে এসেছে। এই খাবার নষ্ট হওয়ার পেছনে অব্যবস্থাপনা ও মানসিকতাকে দায়ী করছেন তারা। যদিও কয়েক বছর আগে এই হার ছিল দ্বিগুণ। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি যশোর শাখা সূত্রে জানা গেছে, যশোর শহরে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ২০০ হোটেল-রেস্তোরাঁ রয়েছে। খাবারের এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪০ হাজার ক্রেতা খাবার কেনেন। পাশাপাশি শহরে ১০টির বেশি কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে। যে সেন্টারগুলোতে বিয়ে, বৌভাত, জন্মদিনসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

যশোরের একাধিক রেস্তোরাঁ ও কমিউনিটি সেন্টারের এক স্বত্বাধিকারী খাবার নষ্টের পেছনে মানসিকতাকে দায়ী করে বলেন, ‘যে মানুষটি হোটেলে খাবার অর্ডার করে খাচ্ছেন, তিনি প্রায় পুরোটাই খাচ্ছেন। অন্যদিকে, যিনি অনুষ্ঠানে দাওয়াত খেতে আসছেন, তিনি কারণে-অকারণে খাবার নষ্ট করছেন। অর্থাৎ যেখানে নিজে বিল দিয়ে খাচ্ছেন, সেখানে খাবারের হিসাব রাখছেন। কিন্তু যেখানে নিজের বিল দেওয়া লাগছে না, সেখানে অবলীলায় খাবার নষ্ট করছেন।’

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি যশোর শাখার সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন দিলশান জানান, যশোর শহর ও শহরতলিতে ১৩১টি হোটেল-রেস্তোরাঁ রয়েছে। এখানে গড়ে প্রতিদিন ৪০ হাজার ক্রেতা নানা ধরনের খাবার গ্রহণ করছেন। তবে এসব হোটেলে ২-৩ শতাংশ খাবার নষ্ট হচ্ছে।

পিজ্জাওলজি ও গ্র্যান্ড দরবার রেস্টুরেন্ট ও কমিউননিটি সেন্টারের স্বত্বাধিকারী দেলোয়ার হোসেন দিলশান দাবি করেন, হোটেল নয়, খাবার মূলত নষ্ট হয় কমিউনিটি সেন্টারের অনুষ্ঠানগুলোতে। কখনো কখনো এই নষ্টের হার ১০-২০ শতাংশ পর্যন্তও পৌঁছে যায়।

তিনি উল্লেখ করেন, মূলত অব্যবস্থাপনার কারণে অনুষ্ঠানগুলোতে খাবার নষ্ট হয়। একই সময়ে অনেক অতিথির চাপ এবং খাদ্য সরবরাহে শৃঙ্খলার ঘাটতি থাকলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

আরও পড়ুনযে শহরে প্রতিদিন নষ্ট হয় দুই টন খাবারচাল আসল না নকল নিজেই যাচাই করুনভাত নাকি রুটি, কোনটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো?সয়াবিন নাকি সরিষা, প্রতিদিনের রান্নায় কোন তেল খাবেনভাইরাল ‘কেকপট্টি’ তুলে দেওয়া কি ভালো হলো, নাকি খারাপনুডলস আর রামেনের পার্থক্য জানেন কি বাংলাদেশ হোটেল রেস্তোরাঁ মিষ্টি বেকারি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক তাইজুল ইসলাম বলেন, যশোর শহর ও শহরতলিতে প্রায় ১৬৫টি হোটেল-রেস্তোরাঁ রয়েছে। তবে এখানে খাবার নষ্ট করার প্রবণতা কম। যদিও কোনো কোনো ক্রেতা না বুঝে বা ভুল খাবার অর্ডার করে বসেন। আবার কেউ কেউ বাড়তি খাবার অর্ডার করেও নষ্ট করেন।

ক্যাফে প্রেসক্লাবের হোটেল কর্মচারী আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে হোটেলে খেতে এসেছে। একসঙ্গে চার-পাঁচ আইটেম অর্ডার দিয়ে অর্ধেক খেয়ে অর্ধেক নষ্ট করে চলে যাচ্ছে। ভাবখানা এমন, টাকা থাকলেই যা খুশি করা যায়।’ ক্যাফে প্রেসক্লাবের পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আগে হোটেলগুলোতে অনেক খাবার নষ্ট হলেও এখন এই নষ্টের পরিধি দুই থেকে তিন শতাংশে নেমে এসেছে। খাবারের দাম বৃদ্ধিসহ মানুষ এই বিষয়ে কিছুটা সচেতন হওয়ায় এখন নষ্টের পরিমাণ কম। আর হোটেলগুলোও চাহিদার ভিত্তিতে খাবার রান্না করায় বেশিরভাগ খাবারই শেষ হয়ে যায়।’

তবে হোটেলে খাবার নষ্টের পরিমাণ অনেক হলেও কমিউনিটি সেন্টারগুলোর অনুষ্ঠানে এই হার প্রায় ১০ শতাংশ। এর কারণ হিসেবে ক্যাটারার্স সার্ভিসের সদস্য হারুণ অর রশিদ বললেন, ‘হোটেলে মাছের কাঁটাটাও চেটে-পুটে খেলেও অনুষ্ঠানে রোস্টে এক কামড় বসিয়েই ফেলে দেয়—এমন নজিরও আছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি কমিউনিটি সেন্টারের কর্মকর্তা বলেন, মূলত মানসিকতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে অনুষ্ঠানে খাবার নষ্ট হয়। জেলা শহর হওয়ায় এখানে মূলত কমিউনিটি সেন্টারে শুক্র ও শনিবার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। দুপুরের আয়োজনে একই সময়ে অনেক অতিথি উপস্থিত হলে খাবার টেবিলে বাড়তি চাপ পড়ে যায়। তখন দ্রুত খাবার পরিবেশনের স্বার্থে পরিবেশন কর্মীদের ব্যস্ততা বাড়লে খাবার নষ্টেরও পরিমাণ বাড়ে। কেউ কেউ খেতে না পারলেও বাড়তি খাবার নিয়ে থাকেন। পাশাপাশি কোনো অতিথিকে বাড়তি কদর করতে তাকেও বাড়তি খাবার পরিবেশন করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই খাবার নষ্ট হয়। এজন্য মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি বলে তিনি মনে করেন।

যশোর পৌর কমিউনিটি সেন্টারের ভেন্যু ইনচার্জ তারিফ হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেক অনুষ্ঠানে ১০ শতাংশের মতো খাবারও নষ্ট হয়। তবে অনুষ্ঠানের আয়োজক এবং অতিথিরা যদি একটু সচেতন হন, তাহলে খাবার নষ্ট হওয়ার হার অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। সেক্ষেত্রে খাবার পরিবেশন, সময় ব্যবস্থাপনাও নজর দিতে হবে।’

আগে কমিউনিটি সেন্টারের অনুষ্ঠানগুলোতে অনেক খাবার নষ্ট হতো। তবে এখন তার পরিমাণ অনেক কম বলে জানান যশোর পৌর কমিউনিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুল আলম।

তিনি বলেন, বিশেষ করে খাবার পরিবেশনের ক্ষেত্রে ক্যাটারার্স সার্ভিস যুক্ত হওয়ায় খাবার পরিবেশনে শৃঙ্খলা এসেছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে অতিথি প্রতিযোগিতার মানসিকতা দেখালে খাবার নষ্ট হওয়ার প্রবণতা বাড়ে।

যশোর সরকারি এমএম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন বলেন, ‘আমাদের অনুষ্ঠানগুলোতে খাবার নষ্ট করার প্রবণতা রয়েছে। একটা সময় ছিল, যখন আমাদের বেশিরভাগ মানুষের বাড়িতে ভালো মানের খাবার শুধু উৎসব আয়োজনেই রান্না হতো। সেসময় খাবার নিয়ে প্রতিযোগিতাও হতো। এই দুয়ে মিলে অনুষ্ঠানে বাড়তি খাবার গ্রহণের প্রবণতা রয়েছে। তবে এটি করতে গিয়ে খাবার নষ্টেরও পরিমাণ বাড়ে। তবে এজন্য মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। আমরা যদি নিরন্ন মানুষের কথা ভাবতে পারি, তাহলে হয়তো খাবার নষ্ট করার হার কমাতে পারবো।’

এসআর/জিকেএস