আইন-আদালত

শেখ হাসিনার সর্বোচ্চ সাজার দাবি রাষ্ট্রপক্ষের

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলায় টানা পঞ্চম দিনে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করা হয়েছে। এদিন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।

তিনি এ মামলায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ সাজার দাবি করেন। সেই সঙ্গে আসামিদের অবৈধ সম্পত্তি ক্রোক করে গণঅভ্যুত্থান ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন চিফ প্রসিকিউটর। তিনি জানান, আইনে আছে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান সেটি রায়ে কীভাবে দেবেন তা আদালতের বিষয়।

তাজুল ইসলাম বলেন, তারা মনে করেন, সাবেক আইজিপি মামুন তার জবানবন্দিতে ঘটনা সম্পর্কে সত্য প্রকাশ করেছেন। তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

এ মামলার পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হচ্ছেন মো. আমির হোসেন। তিনি যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করার জন্য প্রস্তুতি নিতে এক সপ্তাহ সময় আবেদন করেন। ট্রাইব্যুনাল আগামী সোমবার (২০ অক্টোবর) থেকে আসামিপক্ষ তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করার জন্য নির্দেশ দেন আদালত। বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম এদিন ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) ট্রাইব্যুনাল–১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলে পঞ্চম দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন হয়। প্যানেলের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম ও গাজী এসএইচ তামিম শুনানি করেন। তাদেরকে সহযোগিতা করেন প্রসিকিউটর ফারুক হোসেন, প্রসিকিউটর মো. আবদুস সাত্তার পালোয়ান ও প্রসিকিউটর মো. মঈনুল করিমসহ অন্যান্য প্রসিকিউটররা শুনানিতে উপস্থিত থাকেন। পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। এই মামলায় গ্রেফতার হয়ে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে আছেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ।

ট্রাইব্যুনালকে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেছেন, তারা মনে করেন সাবেক আইজিপি মামুন ঘটনা সম্পর্কে পূর্ণ সত্য প্রকাশ করেছেন জবানবন্দিতে। তার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সেটা ট্রাইব্যুনাল বিবেচনায় নেবেন।

ট্রাইব্যুনালকে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ১৪০০ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে। একজন মানুষকে হত্যার জন্য যদি একবার মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে ১৪০০ মানুষকে হত্যার দায়ে শেখ হাসিনাকে ১৪০০ বার ফাঁসি দিতে হবে। কিন্তু আইনে এটা সম্ভব নয়। এজন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আমরা তার চরম দণ্ড দেওয়ার জন্য আবেদন করছি। যদি তাকে এ দণ্ড দেওয়া হয় তাহলে ন্যায়বিচার পাবে দেশের জনগণ।

এর আগে রোববর (১২ অক্টোবর) ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা মামলায় প্রথম দিনের মতো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়। পরের দিন সোমবার (১৩ অক্টোবর) ও তার আগে মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) এবং বুধবার (১৫ অক্টোবর) পর পর চারদিন যুক্তিতর্ক বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এদিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করার পর আসামি পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য আগামী সোমবার দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১। আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর প্রসিকিউশন পক্ষ ও রাষ্ট্রে প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল তার জবাব দেবেন। তারই ধারাবাহিকতায় যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) শেষ করা হবে।

এর আগে গত শনিবার (১১ অক্টোবর) সন্ধ্যায় প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে এ যুক্তিতর্ক সরাসরি সম্প্রচার করা হবে এবং রাষ্ট্র ও আসামি উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হলে মামলাটি রায়ের পর্যায়ে চলে যাবে। তারই ধারাবাহিকতায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়।

এর আগে গত বুধবার (৮ অক্টোবর) শেষ ও ৫৪তম সাক্ষী মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার মো. আলমগীরের জেরা শেষে ট্রাইব্যুনাল-১ যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য করেন।

ঐতিহাসিক এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম প্রতীক শহীদ আবু সাঈদের বাবাসহ স্বজনহারা পরিবারের অনেকে। এছাড়া ‘স্টার উইটনেস বা তারকা সাক্ষী’ হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নাহিদ ইসলাম এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। সর্বমোট সাক্ষ্য দিয়েছেন ৫৪ জন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় শেখ হাসিনা, কামাল ও মামুনের বিরুদ্ধে গত ১০ জুলাই আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। একপর্যায়ে মামলায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদ্‌ঘাটনে (অ্যাপ্রোভার) রাজসাক্ষী হতে মামুনের আবেদন মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ৩ আগস্ট থেকে মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়ে ৮ অক্টোবর শেষ হয়।

এ মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপ-পরিচালক মো. জানে আলম খান। পরে তদন্ত করেন উপ-পরিচালক মো. আলমগীর। সার্বিক সহযোগিতা করেন বিশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা। তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীর চলতি বছরের ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে গত ৩১ মে সম্পূরক অভিযোগ দেওয়া হয়। গত ১ জুন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়।

এফএইচ/এসএইচএস/জেআইএম/জিকেএস