মতামত

বিমানবন্দরে আগুন: যেসব প্রশ্নের সুরাহা করতে হবে

দেশের প্রধান এয়ারপোর্ট শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমাবন্দরের কার্গো ভিলেজে ‘লাগা’ অথবা ‘লাগানো’ ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় যথারীতি একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ শনিবার (১৮ অক্টোবর) রাতে গণমাধ্যম পাঠানো এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের উৎস শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো আরেকটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি সংঘটিত একাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জনমনে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গভীরভাবে অবগত রয়েছে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রতিটি ঘটনা গভীরভাবে তদন্ত করছে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদ সুরক্ষায় সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে বলেও জানিয়েছে সরকার।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে। কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বা উসকানির মাধ্যমে জনজীবন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করার সুযোগ দেওয়া হবে না।’

বস্তুত প্রতিটি দুর্ঘটনার পরেই এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি হয় এবং এর মধ্যে কোনো কোনোটির নাম দেয়া হয় উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি। অর্থাৎ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে এবং ঘটনাকে উচ্চমাত্রায় গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের স্বার্থে এইধরনের কমিটি করা হয়। এসব কমিটি তদন্ত করে যথারীতি কিছু সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিবেদনই আলোর মুখ দেখে না। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ জানতে পারে না ওই প্রতিবেদনে কী আছে বা এইধরনের ঘটনা প্রতিরোধে কী কী সুপারিশ করা হয়েছে।

কখনো গণমাধ্যম ও সামাজিক চাপে কিছু প্রতিবেদন উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। কিছু প্রতিবেদন সাংবাদিকরা অনুসন্ধান করে বের করে নিয়ে আসেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, একইরকম ঘটনা আবারও ঘটে। তার মানে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, তার বাস্তবায়ন হয়নি।

তার অর্থ কি এই যে, প্রতিটি ঘটনার পরেই তদন্ত কমিটি হবে এবং ওই কমিটি ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে কিছু সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেবে বটে, কিছুদিন পরে আবার ওই একই ঘটনা ঘটতে থাকবে? এটা হলো প্রথম প্রশ্ন। দ্বিতীয় প্রশ্ন, প্রতিটি বড় দুর্ঘটনা, বিশেষ অগ্নিকাণ্ডের সাথে সাথে সোশ্যাল মিডিয়া এবং সামাজিক পরিসরে সাধারণ মানুষ যে চট করে এগুলোকে দুর্ঘটনার বদলে নাশকতা বলে সন্দেহ করে, তার কারণ কী? অনেক ঘটনা হয়তো পরিকল্পিত বা নাশকতামূলক, কিন্তু যেকোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকেই মানুষ কেন অন্তর্ঘাতমূলক বা ষড়যন্ত্র বলে সন্দেহ করে? এটা কি বিদ্যমান সিস্টেমের প্রতি মানুষের অনাস্থা নাকি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর মানুষের অবিশ্বাসের ফল? কেন এই অনাস্থা ও অবিশ্বাস তৈরি হলো?

তৃতীয় প্রশ্ন, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে বিদেশ থেকে আমদানি করা কোটি কোটি টাকার পণ্য মজুদ থাকে এবং এখান থেকে আমদানিকারকদের কাছে চলে যায়। তার মানে বিমানে যেসব পণ্য দেশে আসে, সেগুলোর প্রথম ও প্রধান আমানতদার হচ্ছে এই কার্গো ভিলেজের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা।

বৈধভাবে আসা পণ্যের বাইরে অবৈধভাবে এবং ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে আনা অনেক দামি পণ্যও এই কার্গো ভিলেজে রাখা হয়। কেননা সব পণ্য গোডাউনে রাখার মতো জায়গা থাকে না। কিন্তু অত্যন্ত লজ্জার হলেও এই অভিযোগ বেশ পুরোনো যে, বিমানের অনেক কর্মচারী এসব দামি পণ্য কার্গো ভিলেজ ও গোডাউন থেকে সরিয়ে নেন। আমদানিকৃত এবং জব্দ পণ্য রেজিস্ট্রি খাতায় তালিকাভুক্ত করে সংরক্ষণের বিধান থাকলেও চুরির উদ্দেশ্যে অনেক সময় এই নিয়ম মানা হয় না। ফলে যেসব অবৈধ পণ্য নিয়ম ধ্বংস করার কথা কিংবা নিলামে তোলার কথা, তার অনেক পণ্যই কর্মচারীরা চুরি করে নিয়ে যায়। কোনো কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই নিয়ম প্রতিপালনে কঠোর হলে তাকে বদলি করে দেয়া হয়, এই অভিযোগও নতুন নয়। সুতরাং, সরষের ভিতরে ভুত থাকলে আপনি ভুত তাড়াবেন কী করে?

একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্বভাবতই উচ্চঝুঁকিপূর্ণ, সংবেদনশীল এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান। সুতরাং এখানে আগুন কেন লাগবে? এরকম প্রতিষ্ঠানে যাতে আগুন না লাগে সেজন্য যেসব নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকার কথা তা কি ছিল বা আছে? কেননা, এরকম স্থানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা নাশকতা না হলে আগুন লাগার প্রধান কারণ বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট। এরকম সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিদ্যুতের লাইন ঠিকঠাক আছে কি না, সেটি নিয়মিত পরীক্ষা করার কথা।

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় বছরের পর বছর ধরে চুরি ও লুটপাটের যে দুষ্টুচক্র গড়ে উঠেছে, সেটি কে ভাঙবে? বরং কেউ ভাঙতে গেলে তার চাকরিই ঝুঁকির মুখে পড়ে। সরকার সরকারি সকল সেবা অনলাইনে তথা ডিজিটালি করার সকল পদক্ষেপ নিলেও দুর্নীতির এই দুষ্টুচক্রে থাকা লোকজন তা বাস্তবায়িত হতে দিতে চায় না। তারা অনলাইন সিস্টেমে নানারকম জটিলতা তৈরি করে রাখে যাতে মানুষ শত ভাগ সেবা অনলাইনে না পায়। কারণ নাগরিকরা শত ভাগ সেবা অনলাইনে পেলে চুরিচামারি বন্ধ হয়ে যাবে। ভুজুং ভাজং দিয়ে মানুষকে হয়রানি করে ঘুষ নেয়া বন্ধ হয়ে যাবে।

বিমানবন্দরে আগুনের সাথে এর হয়তো আপাতদৃষ্টিতে কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র মোটামুটি একইরকম। সুতরাং কোনো ঘটনাকেই চট করে দুর্ঘটনা বলে ওই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখার সুযোগ নেই। বড় কোনো চুরি বা লুটপাট বা অন্যায় আড়াল করার জন্য কার্গো ভিলেজে আগুন দেয়া হয়েছে কি না—সেটি নিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবে তদন্ত করে বের করে আনতে হবে। প্রশ্ন হলো, যারা তদন্ত করবেন তারা কি এই তদন্তে নির্মোহ ও সৎ থাকবেন বা থাকতে পারবেন? যদি সেটা না হয়, তাহলে অতীতের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হবে।

কার্গো ভিলেজে কত শত ব্যবসায়ীর কত কোটি টাকার পণ্য পুড়ে গেলো, সেই হিসাবটা কি জানা যাবে? রাজধানীর বসুন্ধরা শপিংমলের একজন জুতা ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হচ্ছিলো। তিনি মূলত আমদানি করা জুতা বিক্রি করেন। জানালেন, চায়না থেকে আনা তার প্রায় ৫০ লাখ টাকার জুতা ছিলো ওই কার্গো ভিলেজে। আজকেই (রবিবার) এগুলো হাতে পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সব পুড়ে শেষ। এই ব্যবসায়ী কত টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন? যদি না পান অথবা সামান্য কিছু টাকা পান, তাহলে তার এই যে বিশাল আর্থিক ক্ষতি হলো, তার দায়ভার কে নেবে, রাষ্ট্র?

একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্বভাবতই উচ্চঝুঁকিপূর্ণ, সংবেদনশীল এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে কেপিআইভুক্ত প্রতিষ্ঠান। সুতরাং এখানে আগুন কেন লাগবে? এরকম প্রতিষ্ঠানে যাতে আগুন না লাগে সেজন্য যেসব নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকার কথা তা কি ছিল বা আছে? কেননা, এরকম স্থানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা নাশকতা না হলে আগুন লাগার প্রধান কারণ বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট। এরকম সংবেদনশীল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিদ্যুতের লাইন ঠিকঠাক আছে কি না, সেটি নিয়মিত পরীক্ষা করার কথা। উপরন্তু এরকম স্থাপনায় যে মানের তার ও অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করার কথা, সেটি করা হয়েছে কি না—তাও পরীক্ষা করা দরকার।

এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা আদৌ হয়? তারপরও ধরা যাক আগুন লাগলোই। কিন্তু সেটি প্রতিরোধের কী ব্যবস্থা আছে? আগুন প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থাই যে বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে নেই বা ছিল না, সেটি তো স্পষ্ট। সুতরাং বিমানবন্দরের মতো একটি অতি সংবেদনশীল স্থাপনায় যে অগ্নিনির্বাপণের অত্যাধুনিক ব্যবস্থাটিই রাখা হলো না, তার জন্য জবাবদিহি করবে কে? এই অপরাধের শাস্তি ভোগ করবে কে?

শুধু বিমানবন্দর নয়, রাজধানীর যেকোনো স্থানে বড় ধরনের আগুন লাগলে তা নেভাতে ফায়ার সার্ভিসকে বেগে পেতে হয় পানি সংকটের কারণে। অপরিকল্পিত ও আত্মঘাতি নগরায়নের ফলে নদীবেষ্টিত এবং প্রায় ৭০টি খাল এবং কয়েকশো পুকুরবিধৌত এই শহরে এখন জলাধার খুঁজে পাওয়া ভার। খাল ভরাট করা বানানো হয়েছে রাস্তা, উঁচু ভবন। পুকুর ভরাট করে হয়েছে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। যে কারণে বঙ্গবাজারে আগুন লাগলে হেলিকপ্টারে পানি নিতে হয় হাতিরঝিল থেকে। সুতরাং, প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই শহরে পানির কী সংকট!

সুতরাং, বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ এবং এর ঠিক আগেই চট্টগ্রাম ইপিজেড ও রাজধানীর মিরপুরে কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ আগুন ও তাতে বেশ কিছু মানুষের প্রাণহানির ঘটনাকে আমরা যেমন নিছক দুর্ঘটনা বলে উড়িয়ে দিতে পারি না, তেমনি এইসব ঘটনার সঠিক তদন্ত হবে কি না এবং যদি সত্যিই এসবের পেছনে নাশকতা ও অবহেলা থাকে, তাহলে তার জন্য কতজন শাস্তি ভোগ করবে, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে।

জনপ্রিয় ব্যান্ড ফিডব্যাকের ‘উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি’ গানের কয়েকটি লাইন দিয়ে শেষ করা যাক।‘আর আমি শুনি না বোনের কান্নাআর বাবার গোঙানিশুনি গুপ্ত প্রেমিকার আর্তনাদ আরনির্লজ্জ আস্ফালনে খুনিদের জয়ধ্বনিগঠিত হয়েছে উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটিসৌজন্যমূলক সান্ত্বনার সমিতিআর আমলাতন্ত্র জটিলতার মুখে গণতন্ত্র কেন বিপথগামীন্যায়বিচার পাবার আশ্বাসের সমিতি।’

অর্থাৎ আমলাতন্ত্র জটিলতার মুখে বাংলাদেশ যে খাবি খাচ্ছে এবং দুর্নীতির দুষ্টুচক্র থেকে দেশটা নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও বেরিয়ে আসতে পারেনি, তার অসংখ্য উদাহরণ আশেপাশে তাকালেই দেখবেন।

লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।

এইচআর/এমএস