আন্তর্জাতিক

এত নিরাপত্তার পরও ল্যুভর মিউজিয়ামে কীভাবে হলো দুর্ধর্ষ চুরি?

ফ্রান্সের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে রাজপরিবারের গহনা চুরির ঘটনায় তোলপাড় সারাবিশ্ব। রাজধানী প্যারিসের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই মিউজিয়াম থেকে গত রোববার (১৯ অক্টোবর) নয়টি অমূল্য গহনা নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে- এত নিরাপত্তার পরও ল্যুভর মিউজিয়ামে কীভাবে হলো দুর্ধর্ষ চুরি?

এ ঘটনায় শুধু ল্যুভরেই নয়, ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গোটা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েই নতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। চোরেরা কীভাবে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ভেতরে ঢুকে মুকুট, নীলম ও পান্না খচিত নেকলেস নিয়ে পালাতে পারলো? আর ৩৫ হাজার শিল্পকর্ম সংরক্ষিত থাকা প্রায় ৭৩ হাজার বর্গমিটার আয়তনের এমন বিশাল মিউজিয়ামকে আসলেই কতটা নিরাপদ রাখা সম্ভব?

সরকার জানিয়েছে, এই চুরির ঘটনার আগেই ল্যুভরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার পর্যালোচনা শুরু হয়েছিল। তবে মিউজিয়ামের কর্মীদের ইউনিয়ন অভিযোগ করেছে, নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যা আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হয়েছে।

কীভাবে হলো দুর্ধর্ষ চুরি

জানা যায়, তিনজন মুখোশধারী মিউজিয়াম খোলার কিছুক্ষণ পরেই ভেতরে প্রবেশ করে। তারা সেন নদীমুখী দিকের অ্যাপোলো গ্যালারিতে পৌঁছাতে একটি মালবাহী লিফট ব্যবহার করে, যেখানে ফ্রান্সের রাজকীয় গহনার সংগ্রহ রাখা ছিল।

আরও পড়ুন>>ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে সোনার ৯ আইটেম নিয়ে গেছে চোরেরাপ্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে চুরির পর সাময়িক বন্ধ ঘোষণাল্যুভরে নতুন জায়গায় যাচ্ছে মোনালিসা, দেখতে লাগবে বাড়তি অর্থ

চোরেরা কাচ ভেঙে গ্যালারিতে ঢোকে এবং নয়টি মূল্যবান সোনার আইটেম নিয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ সূত্র জানায়, চোরেরা একটি মোটর-স্কুটারে করে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।

দশকের পুরোনো সতর্কবার্তা

ল্যুভরের সাবেক পরিচালক পিয়ের রোজেনবার্গ ১৯৯৮ সালে দিবালোকে এক চিত্রকর্ম চুরি হওয়ার পরই মিউজিয়ামের নিরাপত্তাকে ‘নাজুক’ বলে সতর্ক করেছিলেন।

বর্তমান পরিচালক লরেন্স দে কার ২০২১ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্যারিস পুলিশকে মিউজিয়ামের নিরাপত্তা নিরীক্ষা করতে বলেন। সংস্কৃতি মন্ত্রী রাশিদা দাতি জানিয়েছেন, সেই নিরীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি সুপারিশগুলো ‘কয়েক সপ্তাহ বা মাস আগে’ জমা দেওয়া হয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত রোববার চোরেরা প্রবেশ করলে মিউজিয়ামের অ্যাপোলো গ্যালারির জানালার অ্যালার্ম বেজে উঠেছিল। উপস্থিত পাঁচ নিরাপত্তাকর্মী তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিলে তারা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় কেউ আহত হয়নি।

নিরাপত্তাকর্মী কমানোর অভিযোগ

শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর অভিযোগ, দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়লেও নিরাপত্তাকর্মীদের পদ কমানো হয়েছে। গত ১৫ বছরে প্রায় ২০০ পূর্ণকালীন পদের সমান কর্মী কমানো হয়েছে বলে জানা যায়।

এক ইউনিয়ন কর্মকর্তা বলেন, শারীরিক পর্যবেক্ষণ ছাড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

‘সুদ’ নামের একটি ইউনিয়ন জানিয়েছে, ল্যুভরে নিরাপত্তা পদের ‘ধ্বংসযজ্ঞ’ চালানো হয়েছে।

গত জুনে কর্মীরা এক দিনের ধর্মঘটও করেছিলেন। তাদের দাবি, লোকবলের অভাবে ঠিকমতো দায়িত্ব পালন সম্ভব হচ্ছে না। প্যারিসের এক উপ-মেয়র সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, কর্মীরা নিরাপত্তা দুর্বলতা নিয়ে আগেই সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয় তা উপেক্ষা করেছে।

বিলিয়ন ডলারের সংস্কার প্রকল্প

এমন উদ্বেগের প্রেক্ষিতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এ বছর ল্যুভরের জন্য প্রায় ৯৩০ মিলিয়ন ডলারের সংস্কার প্রকল্প ঘোষণা করেছেন।এর আওতায় ২০৩১ সালের মধ্যে নতুন প্রবেশদ্বার নির্মাণ, বিখ্যাত ‘মোনা লিসা’র জন্য আলাদা প্রদর্শনী হল তৈরি এবং নতুন ‘নিরাপত্তা মাস্টার প্ল্যান’ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শিগগিরই নতুন প্রজন্মের সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হবে।

ফ্রান্সের মিউজিয়ামে বারবার চুরি

ল্যুভর চোরদের একমাত্র নিশানা নয়। গত মাসেই প্যারিসের প্রাকৃতিক ইতিহাস মিউজিয়ামে রাতের বেলা ছয় কেজি সোনার টুকরো চুরি হয়।

ফরাসি কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে বর্তমানে ১ হাজার ২০০ জাতীয় মিউজিয়াম রয়েছে। ২০১৫ সালে মিউজিয়ামে চুরির সংখ্যা সর্বোচ্চ ৩১টিতে পৌঁছায়, ২০২৩ সালে তা ছিল নয়টি এবং ২০২৪ সালে বেড়ে হয় ২১টি।

সূত্র: এএফপিকেএএ/