আবু জাফর ও মোহাম্মদ ওয়ালী নোমান
প্রতিদিন পৃথিবীর কোথাও না কোথাও সড়কে থেমে যাচ্ছে হাজারো জীবন। নীরবে ঘটে যাচ্ছে এক ভয়াবহ বিপর্যয়—যেন এক চলমান মহামারি। যে বিপর্যয়ে হারিয়ে যাচ্ছে স্বপ্ন, ভেঙে পড়ছে পরিবার, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, প্রতি বছর রোডক্র্যাশে প্রাণ হারান প্রায় ১ কোটি ১৯ লক্ষ মানুষ।
এ ছাড়া আহত হন কয়েক কোটি মানুষ, যাদের অনেকেই চিরজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বয়ে বেড়ান। এমন দুর্ঘটনার কারণে বেশিরভাগ দেশের অর্থনীতিতে বছরে প্রায় ৩ থেকে ৫ শতাংশ জিডিপি ক্ষতি হয়—যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এক ভয়াবহ বোঝা। এছাড়াও বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের দুর্ঘটনায় জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ ক্ষতি হয়। এই নীরব হত্যাযজ্ঞ থামাতে এখনই দরকার সাহসী নীতি, দরকার কার্যকর পদক্ষেপ।
বাংলাদেশও এই বৈশ্বিক চিত্র থেকে ব্যতিক্রম নয়। দেশে প্রতিবছর গড়ে ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়, আহত হয় কয়েকগুণ বেশি মানুষ। প্রতিবছর এই সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, এসব দুর্ঘটনার ৭০ শতাংশই ঘটে অতিরিক্ত গতি ও নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাবে। এতে শুধু প্রাণহানি নয়, পরিবার ও জাতির অর্থনীতিতেও মারাত্মক ক্ষতি হয়। ব্র্যাক ইনজুরি রিসার্চ সেন্টারের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ১.৫ থেকে ২ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় প্রতিবছর—যা শিক্ষা বা স্বাস্থ্যখাতে বড় বাজেট ঘাটতি পূরণে কাজে লাগানো যেত।
এই বাস্তবতায় আজ বুধবার (২২ অক্টোবর ২০২৫) দেশে ৯ম বারের মতো জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উদ্যাপন করা হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য— “মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি, কমবে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি”—সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত। কারণ সড়ক নিরাপত্তা জোরদারে এই দুটি বিষয়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
মানসম্মত হেলমেট কেন জরুরি?মোটরসাইকেল এখন বাংলাদেশের শহর ও গ্রামে চলাচলের প্রধান বাহন হয়ে উঠেছে। কিন্তু মোটরসাইকেল আরোহীদের সুরক্ষা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। দেশে ঘটে যাওয়া রোডক্র্যাশে মৃত্যুর প্রায় ৩৫ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। হেলমেট ব্যবহার বাড়লেও মানসম্মত হেলমেটের প্রয়োগ এখনো সীমিত। অধিকাংশ হেলমেট আন্তর্জাতিক মান (ECE 22.05, DOT বা ISI) অনুযায়ী তৈরি নয়; অনেক ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের পাতলা আবরণে “হেলমেট” লেখা থাকে, যা দুর্ঘটনায় মাথাকে কোনো সুরক্ষা দেয় না। বরং এই ধরনের হেলমেট ব্যবহারের ফলে মাথার আঘাতে মৃত্যুর সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, মানসম্মত হেলমেট মাথায় আঘাতজনিত মৃত্যু ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে, আর গুরুতর আঘাত ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করে। ভিয়েতনাম এই বাস্তবতার একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ। Changes in motorcycle-related injuries and deaths after mandatory motorcycle helmet law in a district of Vietnam শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, ২০০৭ সালে দেশটিতে বাধ্যতামূলক মানসম্মত হেলমেট নীতি কার্যকর হওয়ার পর প্রথম বছরেই মাথায় আঘাতজনিত মৃত্যুর হার ১৮ শতাংশ কমে যায়।
জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস কেবল স্মরণ নয়, এটি প্রতিশ্রুতি নবায়নের দিন। এবারের প্রতিপাদ্য— মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি—আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নিরাপত্তা কোনো বিলাসিতা নয়; এটি মৌলিক অধিকার। তাই এখনই সময়, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে একটি সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও কঠোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা যেন প্রতিটি প্রাণের মূল্য রক্ষা করতে পারি।
আর Effect of the helmet act for motorcyclists in Thailand শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, থাইল্যান্ডে হেলমেট আইন কার্যকর হওয়ার পর হেলমেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা পাঁচগুণ বৃদ্ধি পায় এবং মাথায় আঘাতজনিত দুর্ঘটনা ৪১.৪ শতাংশ ও মৃত্যুহার ২০.৮ শতাংশ কমে যায়। মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কা—সব দেশেই একই অভিজ্ঞতা। অথচ বাংলাদেশে এখনো বাজারে মানসম্মত হেলমেট বিক্রির ব্যবস্থা নেই, আমদানীর ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা, আইনি তদারকি দুর্বল, আর পুলিশের অভিযানও মৌসুমভিত্তিক। তবে আশার কথা হচ্ছে মানসম্মত হেলমেটের মান পরীক্ষার জন্য দেশে বিএসটিআই ল্যাব স্থাপন করেছে।
মানসম্মত হেলমেট ব্যবহারের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সরকারের পাশাপাশি আমদানিকারক ও পরিবেশকদেরও দায় নিতে হবে। হেলমেট আমদানিতে আন্তর্জাতিক মান বাধ্যতামূলক করা, ভোক্তা অধিকার ও বিএসটিআই-এর সমন্বিত এবং ব্যবহারের প্রতি নজরদারি, এবং মিডিয়ার সচেতনতামূলক প্রচার একসঙ্গে হলে এর ব্যবহার দ্রুত বাড়বে।
নিরাপদ গতি: প্রাণরক্ষার সহজতম উপায়গতি বাড়লেই বাড়ে ঝুঁকি—এটি পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম। গতিকে রোডক্র্যাশের একটি প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উচ্চ গতি দুর্ঘটনার সম্ভাবনা এবং আঘাতের তীব্রতা উভয়ই বাড়িয়ে দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার Speed Management Manual-এ বলা হয়েছে, গড় গতিতে প্রতি ১ শতাংশ বৃদ্ধিতে রোডক্র্যাশে মৃত্যুর ঝুঁকি ৪ শতাংশ এবং গুরুতর আঘাতের ঝুঁকি ৩ শতাংশ বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে, গড় গতিতে মাত্র ৫ শতাংশ হ্রাস ঘটালে মৃত্যুহার ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব।
সুইডেনের “Vision Zero” নীতি—যেখানে লক্ষ্য ছিল শূন্য রোডক্র্যাশজনিত মৃত্যু—বিশ্বব্যাপী গতি নিয়ন্ত্রণ নীতির সফল উদাহরণ। সুইডেন গতিসীমা পুনর্নির্ধারণ, সড়কের নকশা পরিবর্তন এবং প্রযুক্তি-নির্ভর মনিটরিং (speed camera, automatic penalty system) চালুর মাধ্যমে ২৫ বছরে সড়ক মৃত্যুহার ৫০ শতাংশের বেশি কমাতে সক্ষম হয়েছে। একইভাবে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও নেদারল্যান্ডসও কঠোর গতি নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে।
বাংলাদেশে এখনো অধিকাংশ সড়কে গতিসীমা স্পষ্টভাবে চিহ্নিত নয়। যদিও গতিসীমা নির্ধারণ, সাইনেজের বাস্তবায়ন এবং আইন প্রয়োগের মাধ্যমে যানচলাচলের গতি সীমিত রাখা যায়। সে কারণেই সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এর ধারা-৪৪ এর উপধারা-১ এবং সড়ক পরিবহন বিধিমালা, ২০২২ এর বিধি-১২৫ এর উপধারা-৪ বাস্তবায়নে সড়ক/মহাসড়কে মোটরযানের সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য ২০২৪ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) “মোটরযান গতিসীমা নির্দেশিকা ২০২৪” জারি করে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণে ও এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো নির্দেশিকা প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু নির্দেশিকার সফল বাস্তবায়নের অভাবে সড়কে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। কারণ আমাদের দেশে যানবাহনের প্রযুক্তিগত গতি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই, সড়কের অবকাঠামোগত ত্রুটি, চালকদের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্সিং প্রক্রিয়ায় ত্রুটি রয়ে গেছে। শহরের রাস্তা ও মহাসড়কে বেপরোয়া গতি, ড্রাইভারদের কর্মঘণ্টা, সিটবেল্ট ব্যবহার না করা সহ বিভিন্ন বিষয়ে দুর্বল আইনের প্রয়োগ সড়ক নিরাপত্তাকে আরও বিপন্ন করছে।
একটি সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন এখন সময়ের দাবিসড়কে পথচারী, সাইকেল ও মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সেহেতু আমরা হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত করলেও কিছু বিষয় আমাদের নজর দেওয়া প্রয়োজন। যেমন- মোটরসাইকেল চালকের বয়স, আরোহীর বয়স, উচ্চতা, ওজন কতজন চালকের সাথে উঠবেন এগুলো নিরাপত্তার কিছু বিষয় থাকে। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে আমাদের প্রয়োজন একটি সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন। তাছাড়া সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রিস্ক ফ্যাক্টর হচ্ছে গতি। এই গতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সকলের দায়িত্ব। যেমন: যারা সড়ক বানাবে তারা বিভিন্ন সড়কের জন্য নির্দেশনা প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে, গতি মনিটরিং করবে পুলিশ।
সড়ক নিরাপত্তা কোনো একক সংস্থার কাজ নয়—এটি পুলিশ, বিআরটিএ, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবহন মালিক ও চালকসহ বহু অংশীজনের যৌথ দায়িত্ব। অথচ বাংলাদেশে এখনো সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। বিদ্যমান আইনগুলো খণ্ডিত ও দুর্বল প্রয়োগযোগ্য। ফলে পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও তদারকিতে তৈরি হয় শূন্যতা—যার মাশুল দিতে হয় সাধারণ মানুষকে।
এই প্রেক্ষাপটে এখন সময় এসেছে একটি সমন্বিত ও আধুনিক সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের। গ্লোবাল প্ল্যান ফর দ্য সেকেন্ড ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেফটি (২০২১–২০৩০)-এর “সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচ” এই আইনের ভিত্তি হতে পারে। এই পদ্ধতির মূল বিষয়গুলো হলো—নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ গতি, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী এবং নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা—বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব।
এর জন্য প্রয়োজন বহুমুখী পরিবহন ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, নিরাপদ যানবাহন, মানসম্মত সড়ক অবকাঠামো, সড়কে শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণ এবং দুর্ঘটনা-পরবর্তী দ্রুত সাড়া ব্যবস্থা। সড়ক নকশা, যানবাহনের মান, গতি নিয়ন্ত্রণ, চালক প্রশিক্ষণ, হেলমেট ও সিটবেল্ট ব্যবহার এবং জরুরি চিকিৎসা সেবাকে এক ছাতার নিচে আনলেই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। এ ধরনের আইন শুধু মৃত্যুহার কমাবে না; বরং অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা বাড়াবে, স্বাস্থ্যব্যয় কমাবে এবং নাগরিক আস্থা জোরদার করবে।
জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস কেবল স্মরণ নয়, এটি প্রতিশ্রুতি নবায়নের দিন। এবারের প্রতিপাদ্য—মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি—আমাদের মনে করিয়ে দেয়, নিরাপত্তা কোনো বিলাসিতা নয়; এটি মৌলিক অধিকার। তাই এখনই সময়, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে একটি সমন্বিত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও কঠোর বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা যেন প্রতিটি প্রাণের মূল্য রক্ষা করতে পারি।
লেখক: সিনিয়র কমিউনিকেশন অফিসার ও প্রোজেক্ট ম্যানেজার, রোড সেফটি ইনজুরি প্রিভেনশন প্রোগ্রাম, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট।
এইচআর/জেআইএম