নরওয়ের নাগরিক, কবি ও গবেষক উয়েরা সেথে। বাংলা লোকসংগীতের প্রেমে পড়েছিলেন প্রায় তিন দশক আগে। প্রথম বাংলাদেশে আসেন ১৯৯৮ সালে। সেসময় কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার উত্তর নামাজের চর এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জীবন দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে চরের নারীদের মুখে শুনেছিলেন মারফতি ও মুর্শিদী গান।
প্রথম শুনেই সেই সুরে মুগ্ধ হন এই বিদেশি। প্রেমে পড়েন বাংলার লোকসংগীতে। এরপর থেকে স্থানীয় লোকশিল্পী ও সংগঠকদের নিয়ে ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘মায়ের তরী গুরুগৃহ’।
‘মায়ের তরী গুরুগৃহে’ কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার ৯টি কেন্দ্রে ৬০০ জন শিশু শিক্ষার্থী রয়েছে। সেখানে তারা লালন, বাউল, মারফতি, মুর্শিদী, ভাওয়াইয়াসহ লোকগান শিখছে। পাশাপাশি বাঁশি, একতারা, দোতারা, তবলা, বেহালাসহ দেশীয় বাদ্যযন্ত্র চালানো রপ্ত করছে তারা।
সম্প্রতি জেলার রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের শিতলীরপাঠ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, দূরে ‘মায়ের তরী’ গুরুগৃহ থেকে ভেসে আসছে মাটির সুর ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। শিশুদের সমবেত কণ্ঠে গাওয়া সেই গানে মুখরিত শিতলীরপাঠ এলাকার চারপাশ। হারমোনিয়াম ও তবলায় তাল দিচ্ছেন গুরু নারায়ণ চন্দ্র রায় ও তার সহযোগীরা।
এসময় নারায়ণ চন্দ্র রায় বলেন, মায়ের তরী গুরুগৃহে শিতলীরপাঠ ও আশপাশের গ্রামের প্রান্তিক পরিবারের শিশুরা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে লোকগান ও বাদ্যযন্ত্র শিখছে। এখানে সংগীত শিখে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীতে পড়াশোনা করছেন অনেক শিক্ষার্থী। জেলা শহরের শিশুরা গান ও বাদ্যযন্ত্রের স্কুলে পড়াশোনা করার সুযোগ পেলেও প্রান্তিক শিশুরা ছিল বঞ্চিত। ‘মায়ের তরী গুরুগৃহ’ এসব শিশুদের ভরসার নাম।
গৃহবধূ আদুরী রানি বলেন, “আমার দুই মেয়ে এখানে সংগীত চর্চা করে। বড় মেয়ে সংগীতের পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্র বাজায়। রংপুর বেতারে লোকগান গাওয়ার জন্য বড় মেয়ে ডাক পেয়েছে। ‘মায়ের তরী’ গুরুগৃহ না থাকলে আমরা কোনোদিনও সেই স্বপ্ন দেখতাম না।”
‘মায়ের তরী’ সংগঠনটি এখন গ্রামীণ বিদ্যালয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করছে। শিশুদের জন্য বিশেষ করে তৈরি করা হয়েছে ‘লোকগান শিক্ষা কর্মসূচি’, যেখানে সাপ্তাহিক কর্মশালায় স্থানীয় শিল্পীরা গান শেখান। সপ্তাহে শুক্র ও শনিবার দুদিন চলে গুরুগৃহে লোকসংগীত চর্চা।
‘মায়ের তরী’র পরিচালক সুজন কুমার বেদ বলেন, ‘নরওয়ের কবি, আলোকচিত্রী ও গবেষক উয়েরা সেথে ২০১৬ সালে মায়ের তরী প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে আমাদের ৯টি গুরুগৃহে ৬০০ শিশু লোকগান ও বাদ্যযন্ত্র শিখছে। এখন গ্রামের এই গুরুগৃহগুলো হয়ে উঠেছে লোকগান চর্চার আঁতুড়ঘর।’
রোকনুজ্জামান মানু/এসআর/এমএস