মতামত

বিচারের তিনটি উদাহরণ ও তৃতীয় বিশ্বের কানাগলিতে ঘুরপাক

পরিবারের প্রধান যদি অসৎ চরিত্রের হয়, তাহলে সেই পরিবারের সন্তানদের দৃঢ় চরিত্র হয়ে ওঠা খুবই কঠিন। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এটাই প্রমাণিত সত্য। ঠিক একই কথা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও বলা যায়। যে সব দেশ সভ্য হয়েছে, উন্নতি করছে, তারা শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের চারিত্রিক দুর্বলতাকে প্রকাশ্যে প্রশ্রয় দেয় না। অন্তত আইনের সম্মুখীন হলে রেহাই নাই, যত প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ মানুষই হোক। ফলে জনগণের মধ্যে একটি নিশ্চিত ধারণা তৈরি হয়, অন্যায় করে ধরা পড়লে কোনো ছাড় পাওয়া যাবে না। ফলে সমাজে আইন মেনে চলার প্রবণতা তৈরি হয়। আর যেসব দেশে হামেশাই সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিরা ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, নানা অর্থনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করেন, আইন উপেক্ষা করেন এবং তারপরও ‘আইনের’ দ্বারা সুরক্ষিত হন- সেই সকল দেশে মানুষের আইন মান্য করার কোনো কারণ থাকে না। অর্থাৎ বাপ চোর হলে সন্তান সাধু হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পায় না। সভ্যতার পথে হাঁটা দেশগুলোর নেতারা ব্যাপারটি বোঝেন বলেই আইনকে তারা কোনোক্রমেই সাধারণ মানুষের সামনে খাটো হতে দেন না। তিনটি সাম্প্রতিক ঘটনার উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে, কেন ওই সকল দেশ শনৈঃ শনৈঃ উন্নতির পথে হাঁটছে।

১৭ অক্টোবর শুক্রবার চিন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, চিনের অন্যতম শীর্ষ কমান্ডার জেনারেল হি ওয়াইদঙসহ আরো ৮ জন সামরিক কর্মকর্তাকে মিলিটারি এবং পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। ঘোষণা এসেছে শুক্রবার, কিন্তু অভিযোগ তদন্ত প্রক্রিয়া চলে আসছিল বছর খানেক আগে থেকেই। যাদেরকে বরখাস্ত করা হয়েছে তারা কেউ সাধারণ বা ছোটখাটো পদধারী চিনা নাগরিক নন। জেনারেল হি ২৪ সদস্যের চিনা কমিউনিস্ট পার্টি পলিটব্যুরোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান।

পশ্চিমা প্রচারমাধ্যম জানিয়েছে, বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই জেনারেল হি পর্দার আড়ালে চলে গেছেন, অর্থাৎ তাকে দেখা যাচ্ছে না। অন্য আরেকজন অভিযুক্ত জেনারেল লিন শিয়াঙজিয়াঙ ছিলেন ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডের প্রধান। এটি চিনা সামরিক বাহিনীর বলা যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইস্টার্ন থিয়েটার হল তাইওয়ানের সঙ্গে যুদ্ধের প্রশ্নে মূল দায়িত্ব পালনকারী কমান্ড। এ ছাড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন অ্যাডমিরাল মিয়াও হুয়া। তার দায়িত্ব ছিল সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তদারকি করা। দেশটি যেহেতু চিন, তাই এই অভিযুক্তদের কপালে কী আছে তা অনুমেয়। রেহাই পাওয়া তো দূরের কথা।

এই চিন ছিল বরাবরই একটি দুর্নীতিপ্রবণ দেশ। এমনকি কট্টোর কমিউনিস্ট শাসনের অধীনেও চিনে দুর্নীতি ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। বিশেষ করে ১৯৭৮ সালে দেং জিয়াও পিঙের অর্থনৈতিক সংস্কারের পর দুর্নীতি আরো বেড়ে যায়। এই নীতিতে ছিল বিদেশি বিনীয়োগ উৎসাহিত করা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের থেকে বজ্রমুষ্ঠি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া। চিনের জন্য এই সংস্কার কাজে দিয়েছে বটে তবে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ততটা দেখা যায়নি। খুবই মজার ব্যাপার। এটি তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য একটি পরম উদাহরণ হিসাবে দেখা যেতে পারে।

চিনা সাবেক প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও তার ১০ বছরের নেতৃত্বকালে এসব লক্ষ করেও খুব একটা অ্যাকশন নিতে পারেননি। নানা কারণ ছিল। তবে তিনি ২০১২ সালে ১৮তম কমিউনিস্ট পার্টি কংগ্রেসে ভাষণ দিয়ে বলেছিলেন, ‘যদি আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হই, চিনা কমিউনিস্ট পার্টি ভয়ানক বিপদগ্রস্ত হবে, পার্টি ভেঙে যেতে পারে, এমনকি রাষ্ট্রও ভেঙে পড়তে পারে।’

শি জিঙপিং কথাগুলো মনে রেখেছেন। তিনি ক্ষমতায় এসে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুধু মুখে নয়, সত্যিকার যুদ্ধ শুরু করেছেন। এর আগে ১২০ জন অতি উচ্চ পর্যায়ের পার্টি ও পিপলস লিবারেশ আর্মির কর্মকর্তাকে বিচারের সম্মুখীন করেননি, চিনের ২৩ লাখ সরকারি কর্মচারিকে দুর্নীতির দায়ে বিচারের আওতায় এনেছেন। এবং লক্ষ্য করলেই দেখবেন, চিনের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন ঘটেছে এই এক যুগেই।

একটি দেশের উন্নতি নির্ভর করে দেশটি কতটা অনিয়ম- দুর্নীতি সহিষ্ণু তার ওপর, আইন কতটা কার্যকর তার ওপর। দেশের আদালত কতটা স্বাধীন, কতটা দুর্নীতিমুক্ত, কতটা রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত তার ওপর। আমরা উন্নয়নশীল দেশসমূহে সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, ‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, আইন সবার জন্য সমান’। কিন্তু এই সকল দেশে কোনো কালেও আদালত স্বাধীন হতে পারেনি, এজলাসে বসা ব্যক্তিরা স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। যে কারণে এই দেশগুলো খাদের কিনারায় পড়ে আছে।

দ্বিতীয় ঘটনাটি ফ্রান্সের। ২০০৭ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন নিকোলাস সারকোজি। তার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতির মামলা হয়। একটি মামলায় আদালত তাকে ৫ বছরের কারাদন্ডের আদেশ দেন এবং ২১ অক্টোবর ৭০ বছর বয়সী এই রিপাবলিক দলের নেতা এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট বাড়ি থেকে বের হয়ে কারাভোগের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে জেলখানায় চলে যান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ? তিনি তার ২০০৭ সালের নির্বাচনে লিবিয়ার তৎকালীন নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির কাছ থেকে অর্থনৈতিক সহায়তা নিয়েছিলেন জিয়াদ তাকিয়েদিন নামের একজন লেবানিজ ধনকুবের মাধ্যমে। তিনি জেলখানায় প্রবেশের পূর্বে বেশকিছু ফরাসি নাগরিক দাঁড়িয়ে তার পক্ষে ‘সারকোজি’ ‘সারকোজি’ বলে চিৎকার করে আবেগ প্রদর্শন করেছে। কিন্তু তারাও জানে এই মামলা প্রমাণিত হওয়ায় সারকোজিকে জেল খাটতেই হবে। একে ফ্রান্সে ‘পলিটিক্যালি মোটিভেটেড’, বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলার সুযোগ নেই।

তবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিন বলা হচ্ছে তৃতীয় ঘটনাটিকে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাবেক ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার জন বোল্টনের ব্যাপারে। তিনি ট্রাম্পের প্রথম দফায় অ্যাভাইজার ছিলেন। পরে ট্রাম্পের সঙ্গে তার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় সমালোচক। তিনি লিখেছেন, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আনফিট বা অযোগ্য। মামলা হয়েছে আরো দুই ট্রাম্প সমালোচক এফবিআই’র সাবেক পরিচালক জেমস কোমি এবং নিউইয়র্কের সাবেক এটর্নি জেনারেল লেটিশিয়া জেমসের বিরুদ্ধেও।

ট্রাম্প চাচ্ছেন তাদের শাস্তি হোক। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে আদালতে তাদের মামলা টিকবে না। কিন্তু বোল্টনের বিরুদ্ধে মামলাটি শক্ত। তার মানে যতই ট্রাম্প প্রভাবশালী হন না কেন, আদালতের উপর তার রাজনৈতিক প্রভাব খাটাতে পারবেন না। চিন, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রে যে দুর্নীতি নেই তা নয়। কিন্তু সবাই যখন জানে যে ঘুষ দিয়ে আদালত থেকে বের হওয়া যাবে না, তখন নাগরিকদের সমঝে চলতে হয়। ১৪০ কোটি মানুষের দেশ চিনে প্রতি ১ লাখে অপরাধের সংখ্যা ০.৫০! এই চিনে ৬৫ শতাংশ মানুষ কয়েক বছর আগেও ছিল দুর্নীতি ও অপরাধপ্রবণ। অবিশ্বাস্য মনে হয় না?

শাসন ব্যবস্থা যাই হোক, একটি দেশের উন্নতি নির্ভর করে দেশটি কতটা অনিয়ম- দুর্নীতি সহিষ্ণু তার ওপর, আইন কতটা কার্যকর তার ওপর। দেশের আদালত কতটা স্বাধীন, কতটা দুর্নীতিমুক্ত, কতটা রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত তার ওপর। আমরা উন্নয়নশীল দেশসমূহে সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, ‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, আইন সবার জন্য সমান’। কিন্তু এই সকল দেশে কোনো কালেও আদালত স্বাধীন হতে পারেনি, এজলাসে বসা ব্যক্তিরা স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। যে কারণে এই দেশগুলো খাদের কিনারায় পড়ে আছে।

এই দেশগুলোতে শুধু আদালত অকর্মন্য নয়। উপরের যে তিনটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে এবং তার যে তদন্ত হয়েছে, সেরকম দক্ষ তদন্তের ক্ষমতাও উন্নয়নশীল দেশে নাই। যেসব প্রতিষ্ঠান বড় বড় মাছগুলো ধরবে, সেই রকম প্রতিষ্ঠানই দাঁড় করানো যায়নি। লঙ্কায় যে যায় সেই যদি রাবণ সেজে বসে তাহলে কোনো সম্ভাবনাই আর থাকে না। আর এই কানাগলিতেই পড়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলো।

লেখক: সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক।

এইচআর/জেআইএম