হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনটি জেলার সবচেয়ে ভাটি এলাকা। ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৩৩৪ জন ভোটারের মধ্যে এ আসনে হিন্দু ভোটার রয়েছেন প্রায় ১ লাখ। জয়-পরাজয় মূলত নির্ভর করে তাদের ভোটের ওপরই। ফলে আসনটি আওয়ামী লীগের দখলেই থেকেছে বারবার।
১৯৮৪ সালে জেলা ঘোষণার পর থেকে এই আসনে বিএনপি একবার ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী দুইবার জয়ী হয়েছেন। বাকি সব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।
বিগত ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের কারণে এবার নির্বাচনে ভোটের মাঠ থেকে হারিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। এ সুযোগে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে বিএনপি। মনোনয়ন প্রত্যাশী কেন্দ্রীয় দুই নেতা শক্ত অবস্থান নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। এতে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন নেতাকর্মীরা। ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, গ্রাম সর্বত্রই নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য এসেছে। প্রায় প্রতিদিনই চলছে সভা-সমাবেশ, ৩১ দফা বাস্তবায়নের লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ।
অপরদিকে আশা ছাড়ছে না জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এবং খেলাফত মজলিস।
আরও পড়ুন- ভোটের হাওয়ায় এলাকায় ভিড় করছেন বিএনপির প্রবাসীরাআ’লীগের ঘাঁটিতে বিএনপির কোন্দল, সুবিধা পেতে পারে জামায়াত
হবিগঞ্জ-২ আসন থেকে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির প্রার্থী তৎকালীন মন্ত্রী সিরাজুল হোসেন খান, ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ থেকে শরিফ উদ্দিন আহমেদ, ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি থেকে জাকারিয়া খান চৌধুরী ও ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে শরিফ উদ্দিন আহমেদ নির্বাচিত হন। তার মৃত্যুর পর ১৯৯৭ সালের উপ-নির্বাচনে এ আসনে এমপি হন আওয়ামী লীগ থেকে সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ থেকে নাজমুল হাসান জাহেদ, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে আব্দুল মজিদ খান এবং ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ থেকে ময়েজ উদ্দিন শরীফ এমপি নির্বাচিত হন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন পেশায় একজন চিকিৎসক। ২০০৬ সালে বিএনপিতে যোগ দিয়েই তিনি কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ পান। ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। দীর্ঘদিন তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদে দায়িত্ব পালন করছেন। চিকিৎসক হিসেবেও তার যথেষ্ট সুখ্যাতি রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প, সভা-সমাবেশ করে নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন। এলাকার রোগীদের ঢাকায় চিকিৎসা করাতেও ভূমিকা রাখেন তিনি।
আরও পড়ুন- প্রবাসে বিএনপির ওসমান ফারুক, মাঠে সরব জামায়াতের জেহাদ খানবিএনপির ঘাঁটিতে জয়ের স্বপ্ন জামায়াতের
এদিকে সৌদি আরব বিএনপির সভাপতি আহমেদ আলী মুকিব ১৯৭৯ সালে বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। সৌদি আরবে থেকে তিনি মধ্যপ্রাচ্য বিএনপির সমন্বয়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ক্রমান্বয়ে দেশের রাজনীতিতেও নিজের অবস্থান তৈরি করেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিবারের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের রোষানলে পড়তে হয় তাকে। দীর্ঘদিন দেশে ফিরতে পারেননি। তবে বিদেশে থেকেও এলাকার রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব গড়ে তোলেন। সংগঠিত করেন নেতাকর্মীদের। কয়েক বছর আগে তাকে কেন্দ্রীয় বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি দেশে আসেন। এরপর থেকে বিরামহীনভাবে সভা-সমাবেশ, বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা কর্মসূচির লিফলেট বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ ও গণসংযোগ করে চলেছেন।
অপরদিকে ১৭ বছর মাঠের রাজনীতিতে অনেকটা অনুপস্থিত জামায়াত এখন অনেকটা নির্বিঘ্নে দল গোছাচ্ছে। তারা উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড কমিটি নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে।
আর খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় আমির মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ এলাকায় ‘বড় হুজুর’ হিসেবে পরিচিত। হিন্দু, মুসলিম সব ধর্মের মানুষই তার ভক্ত। ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবেও তার যথেষ্ট সুখ্যাতি রয়েছে। তাই তাকে পুঁজি করেই এগিয়ে যেতে চায় দলটি।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন বলেন, ‘আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে একটি চ্যালেঞ্জের নির্বাচন। মানুষ ১৫ বছর নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেনি। কাজেই আগামী নির্বাচনে জনগণের ভালোবাসা ছাড়া বিজয়ী হওয়া সম্ভব না। আমি ১৮ বছর যাবৎ মাঠে ছিলাম, আছি এবং থাকবো। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে সব নেতাকর্মীর সঙ্গে আমিও কাজ করতে প্রস্তুত আছি।’
আরও পড়ুন- জামায়াতসহ ৫ দলে একজন করে প্রার্থী, বিএনপিতে ছড়াছড়িদলীয় কোন্দলে বিএনপি, সরব জামায়াতের প্রার্থী
আহমেদ আলী মুকিব বলেন, ‘বিএনপি দেশের সর্ববৃহৎ এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। এ দলকে আগামী দিনে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে জনগণের সেবা করার সুযোগ করে দেওয়া আমাদের সর্ব প্রথম চাওয়া। আমি বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জে জনমত তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। আগামী দিনে দল যদি মনে করে আমার দ্বারা এলাকার জনগণের উন্নয়ন হবে, তাহলে আমি জনগণের খেদমত করার জন্য প্রস্তুত আছি। আমি মানুষের চাহিদা পূরণে চেষ্টা করবো। সর্বোপরি দলের চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’
জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বানিয়াচং ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ১২ বছর আগে জামায়াতে ইসলামীর দুইজন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১২ বছরে আমাদের দলীয় কার্যক্রম শতগুণ বেড়েছে। সার্বিক মূল্যায়নে জনপ্রিয়তার দিক থেকে জামায়াতে ইসলামী এগিয়ে আছে। আমি বিশ্বাস করি আল্লাহর ওপর। ইনশাআল্লাহ এ আসনে আমরা বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবো।’
খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ (বড় হুজুর) বলেন, ‘খেলাফত মজলিস কাউকে আগে থেকে মনোনয়ন দেয় না। দলের শুরা কমিটি যাকে মনোনয়ন দেন তিনি নির্বাচন করবেন। শুরা কমিটি যদি আমাকে মনোনয়ন দেন তাহলে আমি নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুত আছি। আশা করি খেলাফত প্রতিষ্ঠায় জনগণ খেলাফত মজলিসকে বিজয়ী করবে।’
এফএ/এমএমএআর/জেআইএম