প্রবাস

আঞ্চলিক নিরাপত্তায় আসিয়ানের ২০ নতুন উদ্যোগ অনুমোদন

কুয়ালালামপুরে শুক্রবার শুরু হয়েছে আসিয়ান প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠক। এ সপ্তাহের শুরুতে অনুষ্ঠিত বর্ণাঢ্য আসিয়ান সম্মেলনের পরে এবারের বৈঠকটি ছিল বেশ নিরিবিলি পরিবেশে। রাজধানীতে কোনো রাস্তা বন্ধ ছিল না, কিংবা যানজটও তৈরি হয়নি—সাধারণ মালয়েশীয়দের জন্য এটি ছিল আরেকটি স্বাভাবিক শুক্রবার।

তবে কুয়ালালামপুর কনভেনশন সেন্টারের ভেতরে ছিল ভিন্ন এক দৃশ্য। দুই ঘণ্টার মধ্যেই আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর প্রতিরক্ষাপ্রধানরা আঞ্চলিক নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ গঠনে ২০টি নতুন উদ্যোগ অনুমোদন করেন—যা এ পর্যন্ত সর্বাধিক সংখ্যক উদ্যোগের রেকর্ড।

বৈঠকের পাশাপাশি একাধিক দ্বিপাক্ষিক আলোচনাও অনুষ্ঠিত হয়। মালয়েশিয়া ও ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারে বৈঠক হয় এবং তিমর-লেস্তের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের মধ্যেও আলোচনা হয়, যা দুই পরাশক্তির মধ্যে সাম্প্রতিক বাণিজ্য-সমঝোতার পর সম্পর্ক উষ্ণ হওয়ার আরেকটি ইঙ্গিত।

আসিয়ানকে প্রায়ই ‘সামরিক প্রভাবহীন সংগঠন’ বলে সমালোচনা করা হয়, কিন্তু মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী দাতুক সেরি মোহাম্মদ খালিদ নোরদিন জানান, এখন আসিয়ান তার ‌কূটনৈতিক আহ্বান ক্ষমতার মাধ্যমে ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে উঠছে।

মালয়েশিয়ার সভাপতিত্বে আসিয়ান সফলভাবে কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডকে আলোচনায় ফিরিয়ে এনেছে এবং ‘কুয়ালালামপুর শান্তিচুক্তি’ নামে একটি সমন্বিত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের ভিত্তি তৈরি করেছে।

একইসঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে বহু প্রতীক্ষিত কোড অব কনডাক্ট প্রণয়নে চীনের সম্মতিও পাওয়া গেছে।

প্রতিরক্ষামন্ত্রীরা বলেন, বিরোধীপক্ষগুলোকে এক টেবিলে বসাতে আসিয়ানের এই সক্ষমতাই এখন তার সবচেয়ে বড় শক্তি—যার ফলে আরও অনেক দেশ আসিয়ানের সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহী হচ্ছে।

নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্র, সমৃদ্ধিতে চীন, উদ্ভাবনে ভারত,আসিয়ান বৈঠকে তিন পরাশক্তির ভূমিকাও স্পষ্টভাবে চিহ্নিত হয়।

মালয়েশিয়ার মন্ত্রী খালিদ জানান, যুক্তরাষ্ট্রকে অঞ্চলটির ‘নিরাপত্তার রক্ষক’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ডিসেম্বর মাসে আসিয়ান-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক মহড়ার পরিকল্পনাও বৈঠকে অনুমোদন করা হয়েছে।

অন্যদিকে, চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাডমিরাল দং জুনের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ বৈঠকে আসিয়ান নেতারা চীনকে ‘বৈশ্বিক সমৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেন—যে দেশ আন্তর্জাতিক আইন মেনে শান্তি ও মধ্যস্থতার মাধ্যমে সংঘাত এড়াতে ভূমিকা রাখবে।

দিনের পরবর্তী অধিবেশনে ভারতকে ‘বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন ও জ্ঞানের বিশ্বব্যাপী ভাণ্ডার’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। আসিয়ান বিশ্বাস করে, প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে ভারতের সহযোগিতা অঞ্চলটির আত্মনির্ভরতা বাড়াতে সহায়ক হবে।

প্রথাগত সামরিক ইস্যুর বাইরে এবার আসিয়ান মনোযোগ দিয়েছে অপ্রথাগত হুমকির দিকে। সাইবার আক্রমণ, ডিজিটাল অপপ্রচার এবং তথ্য বিকৃতি এখন আসিয়ান দেশগুলোর প্রধান উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে।

এক্ষেত্রে ভারতের প্রযুক্তিগত সহায়তা নেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, যদিও চুক্তির বিস্তারিত এখনো প্রকাশ করা হয়নি।

এছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিষয়ে আসিয়ান মন্ত্রীরা প্রথমবারের মতো একটি যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে যাচ্ছেন—যা কোনো আঞ্চলিক জোটের মধ্যে প্রথম।

তবে আসিয়ান তার ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ থেকেও সরে আসছে না। বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল হিসেবে রাখার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক পারমাণবিক পরীক্ষা পুনরারম্ভের নির্দেশের পর মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী খালিদ বলেন, ‘আসিয়ান ১৯৯৫ সালে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল—এই অঞ্চলকে পারমাণবিক ও গণবিধ্বংসী অস্ত্র থেকে মুক্ত রাখবে—আমরা আজও সেই অঙ্গীকারে অটল।’

কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত এবারের আসিয়ান প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠক আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামো, বৃহৎ শক্তিগুলোর ভূমিকা, এবং নতুন প্রজন্মের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আসিয়ানের ঐক্য ও নেতৃত্বের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

এমআরএম