ফ্রয়েড মানুষের রহস্যঘেরা মনোজগতের এক অকৃত্রিম ছবি তুলে ধরেছেন। এই ছবি ভীষণ নির্মোহ, প্রচণ্ড শক্তিশালী। প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মনে তার অন্তর্জগৎ নিয়ে যে রহস্য লুকিয়ে ছিল, ফ্রয়েড তার থেকে আমাদের নিস্কৃতি দিয়েছেন। মনের গঠন ও গড়ন, ব্যক্তিত্বের বিকাশ, সম্মোহন, স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছে, মনঃসমীক্ষণ ইত্যাদি নিয়ে তিনি মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিশ শতকের মাঝামাঝি। বিশ্বের তাবৎ চিন্তাশীল মানুষ এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়েছেন, প্রশংসা করেছেন। আইনস্টাইন ১৯৩৬ সালে ফ্রয়েডের ৮০তম জন্মদিনে লিখেছিলেন, ‘এ যুগের অন্যতম একজন শিক্ষক হিসেবে এ যুগের মানুষ আপনাকে শ্রদ্ধা জানাতে পারছে বলে আমি আনন্দিত।’ ফ্রয়েডের অবদমন তত্ত্ব নিয়ে আইনস্টাইনের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। এ ছাড়া পশ্চিমা দুনিয়ায় বিখ্যাত মানুষগুলো তাঁকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন। এঁদের মধ্যে রম্যা রলা, টমাস মান, এইচ জি ওয়েলস, ভার্জিনিয়া উলফ অন্যতম।
ফ্রয়েডের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা পেতে তাঁর অন্তত ৪টি বিষয়ের ওপর মনোযোগ দেওয়া জরুরি: মানস নিয়ন্ত্রণবাদ, জীবন-মৃত্যু দ্বিপক্ষবাদ, বাল-যৌনতা ও নির্জ্ঞান। ফ্রয়েড তাঁর কর্ম অভিজ্ঞতা থেকে প্রত্যয়গুলো সম্পর্কে সবিশেষ জ্ঞান লাভ করেন। ফ্রয়েড ছিলেন মূলত জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী হারম্যান লুডভিগ ফারদিল্যান্ড ভন হেমহজ-এর অনুসারী। হেমহজ মনে করতেন যে কোনো মানসিক ঘটনার পেছনে কোনো না কোনো কারণ আছেই। ‘এটা কেন ভাবছেন?’ অনেক সময় এর উত্তরে আমরা বলি, ‘আমার মনে হচ্ছে’। আমার মনে অন্য কিছু না হয়ে এটাই কেন মনে হচ্ছে? এটা কি শুধু এমনি এমনি? হেমহজ অবশ্য এর উত্তরে বলছেন, না। প্রতিটা মানসিক ঘটনার অবধারিত একটা কারণ থাকবেই। ফ্রয়েড এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর স্বপ্নতত্ত্বে। স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন নয়। এ যেন গৌড়ের কবির মতো, ‘এসো ভাই, তোলো হাই, শুয়ে পড়ো চিত,/ অনিশ্চিত এ সংসারে এ কথা নিশ্চিত—/ জগতে সকলি মিথ্যা সব মায়াময়,/ স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়।’ স্বপ্নের ঠিকঠাক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমরা ফ্রয়েডের কাছ থেকে ছাড়া অন্য কোথাও দেখি না।
মানুষের মনের ভেতর দুটো বিপরীতমুখী প্রবণতা আছে, একটা সদর্থক অন্যটা নঞর্থক অর্থাৎ একটা জীবনমুখী অন্যটা মৃত্যুমুখী। প্রতিটা জীবনের একটা অভিন্ন প্রবণতা আছে। সে নিজেকে রক্ষা করতে চায়; সাথে সাথে নিজেকে প্রসারিত করতে চায় বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে। একসময় ফ্রয়েড বিশ্বাস করতেন, মানুষ বুঝি শুধুই নিজেকে নিয়ে ভাবে মানে জীবনমুখী। এটাকে ফ্রয়েডের ভাষায় বলা হয়েছে এরস। পরে তাঁর ধারণা হয়েছে, মানুষের আরেকটা সাংঘাতিক প্রবৃত্তি আছে, সেটা হচ্ছে জীবন বিমুখী। যাকে ফ্রয়েড বলছেন থ্যানাটস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রয়েডের মনে মানুষের এই ধ্বংস প্রবৃত্তি সম্পর্কে নতুন এক বোধ জন্মায়। থ্যানাটস প্রবৃত্তির কারণেই মানুষ বিবর্তনের উল্টোদিকে ছুটতে চায় কোনো কোনো সময়।
ফ্রয়েডের আরেকটা বিশেষ দিক সবার নজরে পড়েছে, সেটা তাঁর বাল-যৌনতা বা শৈশব যৌনতার ধারণা। অনেকেই এটাকে গ্রহণ করেছেন, অনেকেই তীব্র সমালোচনা করেছেন। ফ্রয়েড বলতে চেয়েছেন, মানুষের দেহ থেকে যৌনতাকে আলাদা করা সম্ভব নয়। দেহ চায় সব সময় সুখ। বিশেষ করে শৈশবকাল থেকে শিশু এর ভেতর দিয়ে বড় হয়। ফ্রয়েডের মতে সুখ দুভাবে মানুষ পেয়ে থাকে। অন্যকে দুঃখ দিয়ে সুখ পাওয়া যায় আবার অত্যাচারিত হয়েও মানুষ সুখ পায়। ফ্রয়েডের ভাষায়, একে যথাক্রমে ধর্ষকাম ও মর্ষকাম বলে। জন্ম থেকে শুরু হয়ে বয়সের বিভিন্ন ধাপে শিশুর যৌনকেন্দ্র পাল্টায়। এ ছাড়া ছেলেশিশু তার মায়ের প্রতি একধরনের আকর্ষণ বোধ করে। ফ্রয়েড এটাকে ইডিপাস এষণা নাম দিয়েছেন। ফ্রয়েডের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ সত্যের উন্মোচন হচ্ছে নির্জ্ঞান মনের ধারণা। মানুষের মনকে তিনি তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন, চেতন, অবচেতন এবং নির্জ্ঞান। নির্জ্ঞান বিষয়টা লাকাঁর আলোচনায় খুবই অর্থবহ হিসেবে দেখা দেবে।
এর থেকেও বড় কথা হলো, মনের উদ্দেশ্যগুলোর উৎসকে ফ্রয়েড তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন: অদস, অহং, ও অধিসত্তা। ফ্রয়েড স্বপ্ন বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এবং মানসিক রোগের কারণ খুঁজতে গিয়ে অদসের সন্ধান পান। শরীর এবং অদস যেন একই জিনিস, একটা অন্যটা থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। শারীরিক চাহিদা মূলত অদসেরই চাহিদা। অদসের ধারণা নাকি ফ্রয়েড পেয়েছিলেন নিটসের কাছ থেকে। অদস হচ্ছে মনের অত্যন্ত প্রাথমিক ও মৌলিক স্তর, যা শুধু সুখ নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়। অদসের শক্তিকে ফ্রয়েড বলেছেন লিবিডো। অদস প্রকৃতপক্ষে অন্ধ এবং নৈতিকতাবর্জিত। মনের পরের স্তর অহং সম্পর্কে ফয়েডের ধারণা বেশ ইতিবাচক। মনের অনেক ইচ্ছা সমাজ বাস্তবতা থেকে বেশ দূরে। সমাজ অসমর্থিত এসব ইচ্ছে মন অবদমিত করে রাখে। মনে রাখতে হবে, অবদমিত ইচ্ছাগুলো অদসেরই ইচ্ছা। কিন্তু বাস্তবতা তো সেসব ইচ্ছাপূরণ করতে দেয় না। মন যখন বুঝতে পারে যে, অদস আসলে সামাজিক পরিবেশ থেকে আলাদা। তখনই জন্ম নেয় অহং স্তর। এরপর মনের চূড়ান্ত স্তর বলতে বোঝায় আধশাস্তা বা সুপার ইগো। অধিশাস্তা অনেকটা অভিভাবকের মতো। অদসের ওপর চোখ রাঙায়। নৈতিক পথে চলতে দারুণভাবে নির্দেশনা দেয়। লাকাঁর আলোচনায় ফ্রয়েডের বিষয়গুলো আমাদের ভীষণভাবে সহায়তা করবে। এ কারণে আমরা দেখাতে চাই, লাকা কীভাবে বিষয়গুলো দেখেছেন। অর্থাৎ বিষয়গুলো মূল্যায়নের ক্ষেত্রে তাঁর নিজের কী সংযোজন ছিল।
>> লাকাঁর কথালাকাঁর কথা বেশ পরিষ্কার। মানুষের মনের নির্জ্ঞান প্রকোষ্ঠ অনেকটা ভাষার মতো সাজানো। অর্থাৎ ভাষার যেমন কাঠামো থাকে তেমনই অবদমিত ইচ্ছা এবং তার নির্জ্ঞান স্তরে জমা পড়া আকাঙ্ক্ষা ভাষার কানুনের মতো আইন মান্য করে চলে। সেগুলো মানুষের বক্তব্য, বিবৃতি এমনকি স্লিপ অব ট্যাংয়ের মতো বিষয়গুলোর ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসে। যেমন ধরুন এক ভদ্রলোক সেমিনারে সব সময় সকালবেলার দিকে বক্তব্য দিতে ভালোবাসেন। এই সময়েই তিনি অভ্যস্ত। একদিন সন্ধ্যাবেলা বক্তব্য দিতে গিয়ে সবাইকে ‘গুড মর্নিং’ বলে সম্বোধন করে বসলেন। এটাতে তার অবচেতন মনের গভীর থেকে প্রকাশিত হয়েছে লুকানো ইচ্ছা।
লাকাঁর চিন্তায় দুটো বিষয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বিষয় দুটো হলো সিগ্নিফাইয়ার ও সিগ্নিফাইড বাংলায় বললে দাঁড়ায় অর্থকারক ও কৃতার্থ। সিগ্নিফাইয়ার হচ্ছে কোনো শব্দের বস্তুগত আকার যেমন হতে পারে, গাছ, পাখি, ফুল, প্রজাপতি ইত্যাদি। অন্যদিকে সিগ্নিফাইড হলো ওই শব্দটা আমাদের মনের ভেতর যে ধারণা তৈরি করে সেটা। অর্থাৎ কোনো একটা চিহ্নের বস্তুগত চেহারা হলো সিগ্নিফাইয়ার। যেমন ধরুন গাছ। গাছ একটা চিহ্ন। এটা হতে পারে লিখিত একটা শব্দ কিংবা মুখ দিয়ে বলা একটা শব্দ। কিন্তু শ্রোতার কাছে এই শব্দ পৌঁছালে শ্রোতার মনের মধ্যে গাছ সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি হয়। এই তৈরিকৃত ধারণাই হচ্ছে সিগ্নিফাইড। সুস্যুরের মতে, সিগ্নিফাইয়ার ও সিগ্নিফাইড হচ্ছে একটা চিহ্নের দুটো অভিন্ন চেহারা। যার পরিপ্রেক্ষিতে এদের মাঝে সম্পর্ক এক অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা। কিন্তু লাকাঁর কাছে এই সম্পর্ক পরিবর্তনীয় এবং গতিশীল এক প্রত্যয়। লাকাঁ মনে করেন, সিগ্নিফাইয়ার সব সময় অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। লাকাঁ কিছুতেই মানতে রাজি না যে সিগ্নিফাইয়ার ও সিগ্নিফাইড এক রৈখিক ও অবিচ্ছেদ্য অর্থজ্ঞাপক।
মনে রাখতে হবে, সিগ্নিফাইয়ার একটা ধারাবাহিক অর্থের সিঁড়িতে আমাদের নিয়ে চলে। মানে অর্থের মালার মতো একটা একটা পুঁথি বেয়ে বেয়ে আমরা এগোতে থাকি। অর্থের এই রকমফের নিয়ে লাকাঁর ছিল দু’ধরনের অভিমত: একটা মেটোনমি অন্যটা মেটাফোর। মেটানমি আনুভূমিক আর মেটাফোর উলম্বিত। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলা যাক। যেমন ধরুন, কেউ বলছে ‘আমি পান করতে চাই’। কিন্তু মনে রাখার মতো ব্যাপার, সে নিশ্চিতভাবে শুধু পান করতে চায় না। তার এই ইচ্ছার সাথে যুক্ত আছে ‘পার্টি’, ‘পানশালার আড্ডা’, ‘মাস্তি’ ইত্যাদি। তা ছাড়া সেই ইচ্ছের ক্রমবর্তনীতে আরও অনেক ইচ্ছে সারি সারি লুকিয়ে থাকে। অর্থাৎ ইচ্ছা ক্রমাগত অনন্তের পথে চলমান। একটা ইচ্ছার হাত ধরে অন্য ইচ্ছার ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়ার নাম মেটানমি। অন্যদিকে কেউ যদি বলে ‘আমার জীবনটা হয়ে গেছে পান্তা ভাতের মতো’। তাহলে পান্তা ভাতের সাথে জীবনের এই তুলনা থেকে আমরা বুঝতে পারি খুব ‘নিরস’, ‘অর্থহীন’, ‘গতিহীন’ কিংবা ‘পানসে’। এ ধরনের অর্থের তুলনা লাকাঁর মতে নতুন নতুন অর্থকে সামনে নিয়ে আসে। এটাই তাঁর ভাষায় মেটাফোর।
সিগ্নিফাইয়ার ও সিগ্নিফাইডের ভেতর যে পরিবর্তনশীল সম্পর্ক এবং সেটা যে অলঙ্ঘনীয় নয়, তার উদাহারণ লাকাঁ দিয়েছেন বিখ্যাত গল্পের প্লট থেকে। গল্পটা আমেরিকান ছোট গল্পকার এডগার এলান পোর ‘পারলইন্ড লেটার’ বা ‘অপহৃত চিঠি’। এডগার এলান পোর গল্পটা লাকাঁ ব্যবহার করেছেন নিজের মতো করে। রানি একটা চিঠি পেয়েছেন। হতে পারে সেটা কারো কাছ থেকে প্রেমের গোপন চিঠি। রানি যখন একান্তে গোপন কোনো জায়গায় চিঠি পড়েছেন, তখন হঠাৎ করে রাজার প্রবেশ। রানি দ্রুততার সাথে চিঠিটা উল্টে রাখলেন। কিন্তু অসাবধানতাবশত চিঠির নাম-ঠিকানা দূর থেকে দেখা গেল। এই মুহূর্তে ধুরন্ধর মন্ত্রীর প্রবেশ। মন্ত্রী রানির উল্টে রাখা চিঠির নাম-ঠিকানা দেখে ফেললেন। মন্ত্রী মনে মনে রানিকে জব্দ করার ফন্দি আঁটলেন। মন্ত্রী রাজার অলক্ষ্যে একটা সরকারি চিঠি ওই জায়গায় রেখে রানির চিঠিটা গায়েব করে দিলেন। রাজা কিছুই দেখলেন না। মন্ত্রীর এই দুষ্কর্ম চোখের সামনে ঘটতে দেখলেও রানি কোনো কথা বললেন না। রানি সাহায্য চাইলেন প্যারিসের সবচেয়ে চৌকশ পুলিশ অফিসারের। পুলিশ এলো মন্ত্রীর বাড়ি। তন্ন তন্ন করে খুঁজল। এমনকি সোফার কাভার কেটে তছনছ করে উল্টে পাল্টে খুঁজল সব জায়গায়। খুঁজে পেলেন না। বহু চেষ্টার পর শরণাপন্ন হলেন গোয়েন্দা দুপ্যার। দুপ্যা অতিথি হয়ে মন্ত্রীর বাসায় গিয়ে অনায়াসে খুঁজে পেলেন সেই অপহৃত চিঠি। লুকিয়ে রাখা চিঠির জায়গায় রেখে এলেন একই রকম অন্যরকম এক চিঠি। সেই চিঠিতে দুপ্যা ফ্রান্সের একজন বিখ্যাত কবি জলিয়ন দে ক্রেব্লিওনের একটা উদ্ধৃতি রেখে এলেন। উদ্ধৃতির অর্থ হলো, সে আসলটা নিয়ে গিয়ে রেখে গেল ডুপ্লিকেট। চিঠিটি দুবার চুরি হলো প্রায় একই কায়দায়।
চলবে...
আগের পর্ব> ধারাবাহিক রচনা-এক; জ্যাক লাকাঁর মনঃসমীক্ষণ: ফ্রয়েডের পুনর্পাঠ
এসইউ/জেআইএম