আন্তর্জাতিক

লুফি থেকে হামতারো, জেন-জি আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠছে পূর্ব এশিয়ার পপ সংস্কৃতি

জাপানের জনপ্রিয় মাঙ্গা ও অ্যানিমে সিরিজ ওয়ান পিস’র নায়ক মাংকি ডি. লুফি প্রাণবন্ত একজন কিশোর জলদস্যু। তার মুখে সবসময় থাকে হাসি, আর মাথায় থাকে খড় দিয়ে বানানো হ্যাট (টুপি)। লুফি ও তার দল সমুদ্র পাড়ি দেয় অমূল্য ধনসম্পদের খোঁজে, পথে পথে লড়াই করে দুর্নীতিগ্রস্ত ও দমনমূলক ‘ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট’ বা ‘বিশ্ব সরকারের’ বিরুদ্ধে। তাদের পতাকায় দেখা যায় এক জলি রজার- একটি খুলি ও হাড়ের প্রতীকের সঙ্গে লুফির টুপি।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে লুফির এই কাল্পনিক জলদস্যুর পতাকাই বাস্তব জগতে পেয়েছে নতুন অর্থ। চলতি বছরের আগস্টে ইন্দোনেশিয়ায় তরুণরা অর্থনৈতিক সংকট ও কর্তৃত্ববাদী নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে রাস্তায় নামে। সেসময় তাদের হাতে দেখা যায় লুফির ওয়ান পিস পতাকা। সরকার তখন বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের হুমকি দেয়। কিন্তু এতে ওই পতাকার জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়।

সেপ্টেম্বরে একই পতাকা দেখা যায় নেপালে। সেখানে তরুণরা স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেয়, যা শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করে। অক্টোবরে মাদাগাস্কারেও একই প্রতীক দেখা যায়, যেখানে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের পর সেনা অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ফিলিপাইন, পেরু ও মরক্কোতেও দেখা গেছে একই পতাকা।

লুফির জলি রজার পতাকা এখন হয়ে উঠেছে এক বৈশ্বিক প্রতিরোধের প্রতীক। পশ্চিমা পপ সংস্কৃতি একসময় যুবসমাজের বিদ্রোহের প্রতীক ছিল। পাঙ্ক, হিপ-হপ কিংবা রক সঙ্গীতের মাধ্যমে প্রভাবিত হত কিশোর থেকে শুরু যুবকরা। কিন্তু বর্তমান তরুণ প্রজন্ম অনুপ্রেরণা নিচ্ছে জাপানি অ্যানিমে আর কে-পপ সঙ্গীত থেকে।

দক্ষিণ কোরিয়ার জনপ্রিয় ব্যান্ড গার্লস’ জেনারেশন-এর গান ‘ইনটু দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড’ ২০১৬-১৭ সালের দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভে ও ২০২৪ সালে সামরিক আইন বিরোধী আন্দোলনে শোনা গেছে। ওই আন্দোলনে দেশটির দুজন প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়। একই গান ২০১৯ ও ২০২০ সালে হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনে ও ২০২০ সালে থাইল্যান্ডের বিক্ষোভেও বাজানো হয়েছিল।

থাইল্যান্ডে বিক্ষোভকারীরা জনপ্রিয় জাপানি মাঙ্গা সিরিজ হামতারো’র চরিত্রের অনুকরণে হ্যামস্টারের কান পরে ব্যাংককের গণতন্ত্র স্মৃতিস্তম্ভের চারপাশে দৌড়ায়, মুখে স্লোগান তোলে, ‘সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার হলো করদাতার টাকা!’

টোকিওভিত্তিক পপ সংস্কৃতি বিশ্লেষক রোল্যান্ড কেল্টস বলেন, পূর্ব এশিয়া, যাকে একসময় ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ ও রক্ষণশীল’ অঞ্চল হিসেবে দেখা হতো, এখন হয়ে উঠেছে বৈশ্বিক প্রতিরোধ আন্দোলনের চিত্র ও সুরের উৎস।

আজকের তরুণদের জন্য কে-পপ ও অ্যানিমে হয়ে উঠেছে সেই একই সাংস্কৃতিক সংযোগ যা আগে পশ্চিমা সঙ্গীত, সিনেমা ও বইয়ের মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে কোনো প্রতীক বা গান মুহূর্তেই এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছড়িয়ে পড়ছে।

মাদাগাস্কারের ২৬ বছর বয়সী কর্মী শেলি আন্দ্রিয়ামিহাজা অনলাইনে নেপাল ও ইন্দোনেশিয়ার বিক্ষোভ দেখে বুঝেছিলেন, আমরা সবাই একই লড়াই করছি; দুর্নীতি, খারাপ শাসন আর অবহেলার বিরুদ্ধে। তাই তার দলও বেছে নেয়, ওয়ান পিস পতাকা, যা অনলাইনে সহজেই চেনা যায়। এই পতাকা তাদের প্রতিবাদকেও করে তোলে দৃশ্যমান।

লুফি ও তার সঙ্গীদের প্রতি তরুণসমাজের আকর্ষণ নিহিত তাদের আশাবাদ, কিশোরসুলভ সাহস আর বন্ধুত্ব ও ঐক্যের উদ্‌যাপনে। লুফি একবার ‘ডেভিল ফ্রুট’ খায়, যা তাকে করে তোলে রাবারের মতো স্থিতিস্থাপক। এর মাধ্যমে সে ভয়ঙ্কর শত্রুর সামনে দাঁড়ানোর শক্তি পায়। তবে এই ফল তাকে সাঁতার কাটার ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে, যা এক জলদস্যুর জন্য মারাত্মক দুর্বলতা। তবুও, যখনই সে সমুদ্রে পড়ে যায়, তার বন্ধুরা সবসময় তাকে টেনে তোলে।

তরুণরা যখন পুলিশি দমন আর টিয়ার গ্যাসের মাঝেও নিজেদের স্বপ্নের পক্ষে দাঁড়ায়, তখন লুফির সেই অদম্য বিশ্বাসই হয়ে ওঠে তাদের অনুপ্রেরণা। যেমন লুফি বলে, তুমি সারাদিন আমাকে আঘাত করতে পারো, কিন্তু আমি কখনোই আমার স্বপ্ন ছাড়বো না।

দক্ষিণ কোরিয়ার জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লি গিউ-টাগ বলেন, কে-পপের জন্ম ১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে, যখন দেশটি সামরিক একনায়কতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে রূপান্তরিত হচ্ছিল। তাই এর ভেতরে লুকিয়ে আছে নাগরিক প্রতিরোধের চেতনা, যদিও এর গানগুলো মূলত রাজনীতিবিমুখ। অনেক কে-পপ ভক্তই সংগঠিত অনলাইন কমিউনিটির অংশ, যারা সামাজিক প্রচারণায় দক্ষ এবং প্রায়শই প্রগতিশীল আদর্শের পক্ষে দাঁড়ায়।

অ্যানিমের চরিত্রগুলোও আজকের প্রজন্মের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য। এদের জাতিগত পরিচয় অস্পষ্ট, জীবন চলে কল্পনার জগতে। তাই এসব চরিত্র পশ্চিমা নায়কদের তুলনায় বেশি সার্বজনীন। কেল্টসের মতে, লুফি ও তার সহযাত্রীদের সীমাহীন ও প্রাণবন্ত চরিত্রই তাদেরকে নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, মাদাগাস্কারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তরুণদের কাছে আপন করে তুলেছে।

যেসব সমাজে বাকস্বাধীনতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত, সেখানে অ্যানিমে চরিত্রগুলো অনেক সময় ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের ছলে শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাধ্যম হয়ে ওঠে, যদিও তা স্থায়ী হয় না। ইন্দোনেশিয়ার সংসদ এরই মধ্যে লুফির পতাকাকে ‘জাতীয় ঐক্যের জন্য হুমকি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

এসএএইচ