দেশজুড়ে

জয় পেতে মাঠে বিএনপির ৩ জন, সরব অন্যরাও

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাওয়া বইছে হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট ও মাধবপুর) আসনে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে না থাকলেও বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামি দলগুলো মাঠে রয়েছে পুরোদমে। নির্বাচনকে ঘিরে দলগুলো শীতবস্ত্র বিতরণ, বিভিন্ন দিবস পালনসহ সভা-সমাবেশ করে চলেছে। নির্বাচনি কার্যক্রমও চলছে পুরোদমে।

চা বাগান অধ্যুষিত চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলার ভোট বরাবরই নৌকার পক্ষে যায়। তবে এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন থাকায় চা শ্রমিক ও সনাতন ভোটাররা কোনদিকে ভোট দিবেন এটাই দেখার বিষয়। আর তাদের ৪৫ হাজারের বেশি ভোটের ওপর নির্ভর করে এ আসনের জয়-পরাজয়।

১৯৮৬ সাল থেকে এ আসনে একবার বিএনপি, দুইবার জাতীয় পার্টি ও একবার স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন। বাকি সবগুলো নির্বাচনে জয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত হবিগঞ্জ-৪ আসন। এ আসনে মোট ভোটার ৫ লাখ ১০ হাজার জন। এর মধ্যে চুনারুঘাট উপজেলায় ২ লাখ ৫৭ হাজার এবং মাধবপুর উপজেলায় ২ লাখ ৫৩ হাজার জন।

১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে এই আসনে জাতীয় পার্টির সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার এবং ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের এনামুল হক মোস্তফা শহীদ জয়লাভ করেন। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সল জয়ী হলেও ১৯৯৬ সালের জুন আওয়ামী লীগের এনামুল হক মোস্তফা শহীদ জয় পান। ২০০১ ও ২০০৮ সালেও আওয়ামী লীগের এনামুল হক মোস্তফা শহীদ এই আসনে এমপি ছিলেন। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মাহবুব আলী নির্বাচিত হন। তবে সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এই আসনে এমপি নির্বাচিত হন।

আরও পড়ুন- ভোটের হাওয়ায় এলাকায় ভিড় করছেন বিএনপির প্রবাসীরাজয় পেতে মাঠে বিএনপির দুই কেন্দ্রীয় নেতা, বিপরীতে ‘বড় হুজুর’প্রচারণায় এগিয়ে বিএনপির গউছ, মাঠে আছেন অন্যরাও

আগামী নির্বাচনকে ঘিরে এই আসনে মাঠে রয়েছেন বিএনপির তিন মনোনয়ন প্রত্যাশী। জামায়াত ইসলামীতে আছেন একক প্রার্থী। জাতীয় পার্টির কোনো প্রার্থী কিংবা প্রচার-প্রচারণা নেই। খেলাফত মজলিস ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রার্থী ঘোষণা করেছে।

বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে মাঠে আছেন দলটির কেন্দ্রীয় কমিটির স্থানীয় সরকার বিষয়ক সহ-সম্পাদক ও হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাবেক এমপি শাম্মী আক্তার, বিএনপির আইনজীবী পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আমিনুল ইসলাম এবং সায়হাম গ্রুপের চেয়ারম্যান হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সল।

আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থাকা সাবেক এমপি শাম্মী আক্তার শক্ত অবস্থান নিয়ে এবার জোরেশোরেই মাঠে নেমেছেন। দীর্ঘদিন ধরেই নির্বাচনি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন তিনি। শীতবস্ত্র বিতরণ, সভা-সমাবেশ, ক্রীড়াসামগ্রী বিতরণসহ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন নিয়মিত। ভারত সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় মাদক নির্মূলেও সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন তিনি।

অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলামও মাঠে নিজের শক্ত অবস্থান গড়ে তুলেছেন। এলাকার নেতাকর্মীদের পক্ষে হাইকোর্টে মামলা পরিচালনা থেকে শুরু করে এলাকার রাজনীতিতে নিয়মিত অংশ নিয়ে আসছেন তিনি।

সম্প্রতি নির্বাচনি পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছেন সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সলও। তিনিও নির্বাচনি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করেছেন। তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে তিনি দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি আবার সক্রিয় হয়েছেন।

এদিকে সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সলের ভাই জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. শাহজাহান দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেন। তখন দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়।

অপরদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী পরিবর্তিত পরিস্থিতির পর থেকেই চুনারুঘাট ও মাধবপুরে মাঠ গোছানোর কাজ শুরু করেছে। তারা বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে শুরু করে ইউনিয়ন ও উপজেলা এবং পৌর কমিটি গঠনের কাজ শেষ করেছে। জামায়াত এরইমধ্যেই জেলা আমির কাজী মাওলানা মোখলিছুর রহমানকে একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে।

এছাড়া বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আব্দুল কাদের এ আসন থেকে নির্বাচন করবেন বলে শোনা যাচ্ছে। এর আগে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়ে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে তিনি এ আসন থেকে অংশ নেন। সেবার মাত্র এক ঘণ্টায় ৪৫ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছিলেন তিনি। এছাড়া ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরাও মাঠে রয়েছেন। জোটবদ্ধ নির্বাচন না হলে তারা একক প্রার্থী দেবে বলে জানা গেছে।

বিএনপির সাবেক এমপি শাম্মী আক্তার বলেন, ‘প্রথমত আমরা ভোটের অধিকার ফেরত চাই। মূলত ২০০৮ সাল থেকেই এ দেশের মানুষ ভোটের অধিকার হারিয়ে ফেলে। অথচ ভোট আমাদের দেশে একটি উৎসব। তরুণ প্রজন্ম ১৭ বছর ধরে ভোট দিতে পারছে না। তারা ভোটের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সুতরাং ভোটের উৎসব আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত, কোনো দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী যারা মানুষের পাশে থাকবে না দলে তাদের প্রয়োজন নেই। আমরা এমন একজন প্রার্থী চাই যারা বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে নেতাকর্মীসহ আপামর জনগণের পাশে থেকেছে। তৃতীয়ত, বিগত দিনে লড়াই-সংগ্রামে আমি সবসময়ই সক্রিয় ছিলাম। এটি কোনো নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়। এটি মূলত দেশ এবং দলের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই আমি করেছি, করছি।’

শাম্মী আক্তার বলেন, ‘আমার দাদা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, বাবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। আমি সংগ্রামী পরিবারে বেড়ে উঠেছি। দলের দুঃসময়ে ছিলাম, আছি। আমাকে যদি দল মনোনয়ন দেয় তাহলে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছি। আমি আশাবাদী, আমাকে মনোনয়ন দিলে বিজয়ী হবো।’

অ্যাডভোকেট মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের জন্য আমার পূর্ণ প্রস্তুতি আছে। আমার স্ত্রী পরপর দুইবার মাধবপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদে রেকর্ড সংখ্যক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারও পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহোদয় মনোনয়নের জন্য কয়েকটি ক্রাইটেরিয়া দিয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি সবগুলোই আমার আছে। আমার চেয়ে বেশি সেক্রিফাইস কেউ করেনি। হাইকোর্টে মামলা পরিচালনায় কাউকেই আমি কোনো অর্থ খরচ করতে দিইনি। আমার প্রতি যেমন তাদের দাবি ছিল, তেমনি তাদের প্রতির আমার বিশাল দাবি রয়েছে। আমি আশা করি আমাকে যদি দল মনোনয়ন দেয়, তাহলে আমার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হবে।

এদিকে সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সলকে ফোন করে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সংযোগটি কেটে দেন।

জেলা জামায়াতের আমির কাজী মাওলানা মুখলিছুর রহমান বলেন, ‘আমরা দল গোছাচ্ছি। বিভিন্ন ইউনিটের কমিটিগুলো করা হচ্ছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে মাঠে কাজ করে যাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলা ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন, চা বাগান অধ্যুষিত এলাকা। আমরা যদি কখনো সুযোগ পাই, তাহলে এখানে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করবো। মালিকপক্ষ যেন ন্যায্য মুনাফা পায় এবং শ্রমিকরাও যেন তাদের ন্যায্যমূল্য পান- সেই চেষ্টা থাকবে।’

খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় শ্রমবিষয়ক সম্পাদক প্রভাষক আব্দুল করিম বলেন, ‘আমাদের প্রার্থী আহম্মদ আব্দুল কাদের মাঠে রয়েছেন। আগামী নির্বাচনে তিনিই আমাদের প্রার্থী। নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে কিংবা ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হলে আমরা এ আসন চাইবো।’

এফএ/এমএমএআর/জেআইএম