মতামত

সঞ্চয়পত্রের মুনাফা হ্রাস: বিপাকে নির্ভরশীল পরিবারগুলো

বাংলাদেশে সঞ্চয়পত্র কেবল একটি বিনিয়োগ মাধ্যম নয়, এটি লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তার প্রতীক। বিশেষ করে বয়স্ক নাগরিক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, প্রবাসীদের পরিবার, ও বিধবা নারীদের জন্য সঞ্চয়পত্রের মুনাফা প্রায় একমাত্র মাসিক আয়ের উৎস। তাই যখন সরকার সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানোর ঘোষণা দেয়, তখন তা নিছক একটি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত থাকে না; এটি হয়ে দাঁড়ায় হাজারো পরিবারের জীবিকা ও মানসিক স্থিতিশীলতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলা এক সামাজিক ঘটনা।

২০২৫ সালের জুলাই মাসের শুরুতেই অর্থ মন্ত্রণালয় সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর প্রজ্ঞাপন জারি করে। আগে যেখানে পরিবার সঞ্চয়পত্রে পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে মুনাফার হার ছিল প্রায় ১২.৫০ শতাংশ, সেখানে তা নামিয়ে আনা হয়েছে ১১.৯৩ শতাংশে। একইভাবে পেনশনার ও বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রসহ প্রায় সব ধরনের স্কিমে মুনাফার হার গড়ে ০.৫ থেকে ০.৭ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। প্রথম দর্শনে এটি তেমন বড় পার্থক্য মনে না হলেও, বাস্তবে এটি একটি বড় আঘাত— বিশেষ করে যাঁরা মাসে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকার মুনাফায় জীবনযাপন করেন, তাঁদের জন্য।

বাংলাদেশে প্রায় ৭০ লক্ষাধিক ব্যক্তি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছেন। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ খাতে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি। এর একটি বড় অংশ অবসরপ্রাপ্ত বা বয়স্ক নাগরিকদের। তাঁরা মাসে নিয়মিত মুনাফা পান এবং সেই টাকা দিয়েই দৈনন্দিন খরচ, ওষুধ, বাড়িভাড়া, এমনকি সন্তানদের সহায়তা পর্যন্ত চালান। যখন মুনাফার হার কমে যায়, তখন সেই আয়ে সরাসরি ঘাটতি দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যিনি ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রে বছরে ১২.৫% হারে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা মুনাফা পেতেন, এখন তিনি প্রায় ৭ হাজার টাকা কম পাবেন। বছরে ৭ হাজার টাকা কম মনে হলেও, মাসিক ভিত্তিতে এই পার্থক্য প্রায় ৬০০ টাকার মতো— যা অনেক পরিবারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এক মাসের খরচ।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত আরও কঠিনভাবে আঘাত করছে কারণ দেশে টানা দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। খাদ্যদ্রব্য, বিদ্যুৎ, ওষুধ এবং বাড়িভাড়ার খরচ গড়ে ২০–২৫ শতাংশ বেড়েছে। অথচ আয় বাড়েনি, বরং কমেছে। ব্যাংকগুলো যেভাবে আমানতের সুদের হার ৫–৭ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে, তাতে মধ্যবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্তের জন্য সঞ্চয়পত্রই ছিল একমাত্র নির্ভরযোগ্য বিকল্প। ব্যাংকে টাকা রাখলে যেখানে প্রকৃত মুনাফা মূল্যস্ফীতির হারকে ছুঁতে পারে না, সেখানে সঞ্চয়পত্রের উচ্চ সুদ মানুষকে সামান্য হলেও সুরক্ষা দিত। এখন সেই সুরক্ষা স্তরও নড়বড়ে হয়ে গেছে।

সরকার বলছে, সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হয়েছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট রোধে। সত্যিই, সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে যেভাবে বিপুল পরিমাণ অভ্যন্তরীণ ঋণ নেয়, তাতে সুদের ভার বেড়ে যায়। এই ভার কমাতে সুদহার সমন্বয় একটি প্রচলিত পদক্ষেপ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে কেন সাধারণ সঞ্চয়কারীদের ওপরই বোঝা চাপানো হবে?

সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমানো একটি নীতিগতভাবে বিতর্কিত কিন্তু বাস্তবচাপজনিত সিদ্ধান্ত। সরকার হয়তো অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে এটি করেছে, কিন্তু এর সামাজিক ও মানবিক প্রভাব বিবেচনা করা জরুরি ছিল। যারা এই মুনাফা দিয়ে মাসের বাজার করেন, ওষুধ কেনেন, কিংবা বৃদ্ধ বয়সে কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকেন—তাঁদের জন্য এই সিদ্ধান্ত যেন “মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।” উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রয়োজন একটি শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো, যেখানে অবসরপ্রাপ্ত, নিম্নবিত্ত ও নির্ভরশীল শ্রেণির মানুষ রাষ্ট্রীয়ভাবে সুরক্ষিত থাকবে। না হলে মুনাফার হার কমিয়ে অর্থনীতির হিসাব মিললেও, সমাজের অসন্তোষ ও অনিশ্চয়তার হিসাব কোনোভাবেই মেলানো যাবে না।

উন্নত দেশগুলোতে এমন নীতিগত পরিবর্তনের সময় সরকার বিকল্প সুরক্ষা ব্যবস্থা চালু করে। যেমন, ভারতে যখন “ন্যাশনাল সেভিংস স্কিম”–এর হার কমানো হয়, তখন সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য “Senior Citizen Savings Scheme”–এর সুদহার তুলনামূলকভাবে বেশি রাখা হয়, যাতে অবসরপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আবার যুক্তরাজ্যে “Pensioner Bonds” বা যুক্তরাষ্ট্রে “Social Security Benefits” এর মতো ব্যবস্থায় সরকার নির্দিষ্ট বয়সের পর নাগরিকদের একটি স্থায়ী আয় নিশ্চিত করে। বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যবশত এমন কোনো সুনির্দিষ্ট সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই। ফলে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমে যাওয়া মানে এখানে অনেকের কাছে অবসর-পরবর্তী নিরাপত্তা ভেঙে পড়া।

বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের কর্মীরা এত দিন কোনো সার্বজনীন পেনশন সুবিধা পেতেন না। ২০২৩ সালে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হলেও, তা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে এবং জনপ্রিয় হতে সময় লাগবে। বিমা কোম্পানিগুলোর পেনশন প্রোগ্রাম থাকলেও, আস্থার অভাবে মানুষ সেদিকে ঝোঁকেন না। ফলে বাস্তবে সাধারণ মানুষ সঞ্চয়পত্রেই নিরাপত্তা খোঁজেন। এই প্রেক্ষাপটে মুনাফা কমানো তাঁদের জন্য আয়ের সংকোচন এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা—দু’টোই একসঙ্গে ডেকে এনেছে।

একই সঙ্গে এ সিদ্ধান্তের সময়টাও অর্থনৈতিকভাবে প্রতিকূল। কোভিড-পরবর্তী অর্থনীতি এখনো পুনরুদ্ধার পর্যায়ে, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট রয়েছে, ডলারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং জ্বালানি খরচ বেড়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ যে সামান্য সঞ্চয় করতে পারতেন, সেটিও ক্রমে ক্ষয়ে যাচ্ছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি ঋণাত্মক ছিল প্রায় ৭,৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, মানুষ সঞ্চয়পত্র ভাঙাচ্ছেন, নতুন করে কিনছেন কম। এখন মুনাফা কমায় এই প্রবণতা আরও বাড়বে।

অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে, এটি ব্যাংকিং খাতের জন্য কিছুটা সুবিধাজনক হতে পারে। কারণ, সঞ্চয়পত্রে আকর্ষণ কমলে মানুষ হয়তো ব্যাংকে আমানত রাখবে। কিন্তু ব্যাংকের আমানতের ওপর যে সুদের হার দেওয়া হয়, তা ৫ থেকে ৭ শতাংশ— মূল্যস্ফীতির হার যদি ১০ শতাংশ হয়, তাহলে প্রকৃত মুনাফা নেতিবাচক। অর্থাৎ, ব্যাংকে টাকা রাখলে ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। এই অবস্থায় সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমানো মানুষকে বিকল্পহীন অবস্থায় ফেলে দেয়।

অন্যদিকে সরকার যদি যুক্তি দেয় যে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সুদ কমানো জরুরি, তাহলে সেটি আংশিক সত্য হলেও নীতিগতভাবে প্রশ্ন থেকে যায়—কেন বাজেট ঘাটতির ভার সেই মানুষগুলোর ওপর পড়বে, যাঁরা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে রাষ্ট্রকে ঋণ দিচ্ছেন? বড় ব্যবসায়ীদের জন্য কর ছাড়, ব্যাংক ঋণখেলাপিদের পুনঃতফসিল সুবিধা, বা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ট্যাক্স ইনসেন্টিভ বজায় রেখেও সাধারণ সঞ্চয়কারীর আয় কেটে দেওয়া নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

এই সিদ্ধান্তের আরেকটি দিক হলো সামাজিক প্রভাব। বাংলাদেশের অনেক পরিবারে সঞ্চয়পত্রের মুনাফাই সন্তানদের শিক্ষা, চিকিৎসা, কিংবা বাড়িভাড়ার একমাত্র ভরসা। যাঁরা পেনশন পান না, তাঁদের জন্য এটি কার্যত “বেসরকারি পেনশন।” এখন এই মুনাফা কমে যাওয়ায় তাদের জীবনযাত্রার মান আরও নিচে নামবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময় সাধারণত প্রথমে মানুষ খাবারের মান ও পরিমাণ কমায়—এমনটা বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে। ফলে এই সিদ্ধান্ত মানুষের পুষ্টি ও জীবনমানের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

সরকার বলছে, ছয় মাস পর আবার মুনাফার হার পুনর্বিবেচনা করা হবে। তবে বাস্তবে দেখা গেছে, একবার কমানো হার সচরাচর সহজে বাড়ানো হয় না। তাই দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব স্থায়ী হতে পারে। এ অবস্থায় সরকার চাইলে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে পারত— যেমন : অবসরপ্রাপ্ত বা বয়স্কদের জন্য আলাদা সুদহার বজায় রাখা, বা নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য বিশেষ সঞ্চয়পত্র প্রবর্তন। এতে সামষ্টিক ভারসাম্যও থাকত, আবার সামাজিক সুরক্ষাও বজায় থাকত।

সবশেষে বলা যায়, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমানো একটি নীতিগতভাবে বিতর্কিত কিন্তু বাস্তবচাপজনিত সিদ্ধান্ত। সরকার হয়তো অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে এটি করেছে, কিন্তু এর সামাজিক ও মানবিক প্রভাব বিবেচনা করা জরুরি ছিল। যারা এই মুনাফা দিয়ে মাসের বাজার করেন, ওষুধ কেনেন, কিংবা বৃদ্ধ বয়সে কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকেন—তাঁদের জন্য এই সিদ্ধান্ত যেন “মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।” উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রয়োজন একটি শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো, যেখানে অবসরপ্রাপ্ত, নিম্নবিত্ত ও নির্ভরশীল শ্রেণির মানুষ রাষ্ট্রীয়ভাবে সুরক্ষিত থাকবে। না হলে মুনাফার হার কমিয়ে অর্থনীতির হিসাব মিললেও, সমাজের অসন্তোষ ও অনিশ্চয়তার হিসাব কোনোভাবেই মেলানো যাবে না।

লেখক : “দ্য আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট, আমি কি এক কাপ কফিও খাবো না, দ্য সাকসেস ব্লুপ্রিন্ট ইত্যাদি বইয়ের লেখক, করপোরেট ট্রেইনার, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট। hossain.shaiful@gmail.com

এইচআর/এমএস