দেশজুড়ে

রূপকথার গল্পকেও হার মানায় ‘হুলহুলিয়া গ্রাম’

গ্রামের শতভাগ লোক শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের এসএসসি পাস বাধ্যতামূলক ১০০ বছরেও হয়নি মামলা-মোকাদ্দমা দরিদ্র হলে গ্রামবাসীর উদ্যোগে লেখাপড়ার ব্যবস্থা

গ্রাম পরিচালনার জন্য রয়েছে নিজস্ব গঠনতন্ত্র! গ্রামের শতভাগ লোকই শিক্ষিত। নেই বাল্যবিবাহ। শত বছরেও গ্রামে কখনো পুলিশ ঢোকেনি।নিজেদের সমস্যাগুলো নিজেরাই সমাধান করেন গ্রামবাসী। গ্রামে রয়েছে কমিউনিটি সেন্টার, গ্রাম পরিচালনা কমিটির কার্যালয়, ডিজিটাল হাব।

এমনই একটি আদর্শ গ্রামের নাম হুলহুলিয়া। চলনবিলবেষ্টিত নাটোরের সিংড়া উপজেলার চৌগ্রাম ইউনিয়নে অবস্থিত বিস্ময়কর গ্রাম হুলহুলিয়া। জেলা সদর থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে আটটি পাড়া নিয়ে গঠিত গ্রামটির আয়তন প্রায় ২.১৫ বর্গকিলোমিটার। গ্রামটির ছয় হাজার অধিবাসীর মধ্যে চার হাজারই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন চাকরিরত।

যেভাবে হুলহুলিয়া হয়ে উঠলো রূপকথার গ্রাম

একসময় চলনবিল ছিল অথৈ পানির একটি বিল। মাঝে মাঝে দু-একটি গ্রাম, বাকি অংশে বর্ষা মৌসুমে রাশি রাশি পানি। প্রবল ঢেউ, বন্যা আর ঝড়কে মোকাবিলা করে বেঁচে থাকতেন চলনবিলের মানুষ। তখন চলনবিলে একটি মাত্র ফসল হতো—আমন। তবে মাছের প্রাচুর্য ছিল অফুরন্ত। ১৯১৪-১৫ সালের কথা। ওই বছর প্রবল বন্যায় হুলহুলিয়া গ্রামের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় গ্রামে অভাব দেখা দেয়। গ্রামের অনেক চাষি ধান-বীজের অভাবে জমি ফেলে রাখতে বাধ্য হন। সবার মনে কষ্ট, হতাশা।

হুলহুলিয়া গ্রামের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া ছবি

বিষয়টি গ্রামের মাতবর মছির উদ্দিন মৃধার মনে দাগ কাটে। একদিন গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে লোক ডেকে সভায় বসেন তিনি। সিদ্ধান্ত হয়, যাদের ঘরে অতিরিক্ত ধান-বীজ আছে, তারা বিনাশর্তে অন্যদের ধার দেবেন।

সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, খালি জমি ফসলে ভরে ওঠে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্রামের উন্নয়নে ১৯৪০ সালে ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’ নামে একটি পরিষদ গঠিত হয়।

হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আল তৌফিক পরশ বলেন, ‘গ্রামের কোনো সদস্যের কোনো সমস্যা দেখা দিলে প্রথমে ওই পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি মীমাংসা করার চেষ্টা করেন। তারা না পারলে বাকিরা চেষ্টা করেন। তারা না পারলে তখন পাড়ার যে কমিটি আছে, সেই কমিটি বিষয়টি মীমাংসা করার চেষ্টা করে। তারাও ব্যর্থ হলে তখন সামাজিক উন্নয়ন পরিষদে বিষয়টি তোলা হয়। সেখানে যে রায় দেওয়া হয় সেটি সবাই মেনে নেয়। এ কারণেই কাউকে কোর্টে যেতে হয় না। পুলিশ ডাকারও প্রয়োজন হয় না। এটি আমাদের গত ১০০ বছরের ইতিহাস।’

১৯৪০ সালে মছির উদ্দিন সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ গঠন করেন ও গ্রাম পরিচালনার সংবিধান তৈরি করে লিখিত রূপ দেন। এই গ্রামে ১৯৪২ সালে ‘দ্য হুলহুলিয়া ডায়মন্ড ক্লাব’ গঠন করা হয়। মরহুম মফিজ উদ্দিন প্রামানিক ক্লাবটি গঠন করেন। ক্লাবের উদ্যোগে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৩ সদস্যের একটি কমিটি পরিচালনা করে এই ক্লাব।

হুলহুলিয়ায় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছে ‘শেকড়’ ও ‘বটবৃক্ষ’ নামের দুটি অরাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। এই প্রতিষ্ঠানের সদস্য সবাই চাকরিজীবী। তাদের অনুদানে গ্রামের অভাবি ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি, অসহায় মানুষকে সহায়তা ও বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়।

হুলহুলিয়া গ্রামের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া ছবি

হুলহুলিয়া গ্রামের গঠনতন্ত্র

নাটোর থেকে সিংড়া উপজেলা সদরের ওপর দিয়ে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের পাশে চৌগ্রাম বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকেই পশ্চিম দিকে চলে গেছে একটি পাকা সড়ক কালীগঞ্জ পর্যন্ত। এই চৌগ্রাম-কালীগঞ্জ সড়কের মধ্যখানে হুলহুলিয়া গ্রাম। হুলহুলিয়া গ্রামে গেলে প্রথমেই চোখে পড়বে গ্রামের প্রবেশমুখে বিশাল একটি গেট, যেখানে লেখা রয়েছে ‘আদর্শ গ্রাম হুলহুলিয়া’।

গ্রামটিতে স্কুল, মাদরাসা, বাজার, মসজিদ ও গোরস্থানভিত্তিক আলাদা আলাদা পরিচালনা কমিটি রয়েছে। গ্রামবাসীর ভোটে নির্বাচিত হন পরিচালনা কমিটির সদস্যরা। গ্রামবাসী গ্রামের মধ্যে কোনো বিভাজন তৈরি করেন না।

হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আমিনুল হক মন্ডল বলেন, ‘দরিদ্রদের সহায়তায় সবাই একসঙ্গে এগিয়ে আসেন। গ্রামের জনসংখ্যা ছয় হাজার হলেও প্রায় চার হাজার মানুষ গ্রামের বাইরে চাকরি করেন। তারাও অর্থনৈতিকভাবে গ্রামবাসীকে বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেন। ছেলেমেয়েদের জন্য এসএসসি পাস করা বাধ্যতামূলক।’

দেশের অন্যান্য গ্রাম থেকে হুলহুলিয়া গ্রামটিকে যে কারণে পৃথক করেছে তার অন্যতম প্রধান কারণ এই হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ নামের সামাজিক প্রতিষ্ঠানটি। এই পরিষদের মাধ্যমেই গ্রামের সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান এবং গ্রামবাসীর মধ্যে কখনো কলহ দেখা দিলে তা মীমাংসা করা হয়।

হুলহুলিয়া গ্রামের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া ছবি

সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ পরিচালনার একটি কমিটিও রয়েছে। কমিটিতে একজন চেয়ারম্যান ও একজন ভাইস চেয়ারম্যানসহ আরও ২১ জন সদস্য রয়েছেন। তারা সবাই গ্রামের পুরুষ ভোটারদের দ্বারা দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হন।

দুই বছর পর পর ভোটের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হয়। দেশের সংবিধান অনুযায়ী, যারা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হন তারাই সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের নেতৃত্ব নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।

এছাড়া পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটিও রয়েছে তাদের। গ্রামের বিচার বিভাগীয় আটটি পাড়াতেও আলাদা আলাদা কমিটি রয়েছে, যাকে বলা হয় ‘নিম্ন আদালত’। এই কমিটি পাড়ার আকার-আকৃতি অনুসারে ৫-৮ সদস্যের হয়ে থাকে।

সুযোগ-সুবিধা

হুলহুলিয়া গ্রামের মানুষজন শতভাগ শিক্ষিত। সব ছেলেমেয়ের জন্যই এসএসসি পাস করা বাধ্যতামূলক। কোনো পরিবারের ছেলেমেয়ে দরিদ্রতার কারণে তার সন্তানকে পড়ালেখা করাতে না পারলে দরিদ্র তহবিল কমিটি থেকে সেই ছেলেমেয়ের শিক্ষার দায়িত্ব নেওয়া হয়। চাকরিতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে সহায়তা করা হয়। তবে চাকরি পাওয়ার পর তা পরিশোধ করতে হয়।

গ্রামে একটি প্রাইমারি স্কুল, একটি হাইস্কুল, একটি মাদরাসা ও একটি মসজিদ রয়েছে। গ্রামটিতে দুই শতাধিক প্রকৌশলী, শতাধিক এমবিবিএস ডাক্তার, ১৭ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ১১ জন বিচারকসহ নানা পেশার মানুষ ও প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব রয়েছেন।

হুলহুলিয়া গ্রামের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া ছবি

গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গ্রামে মসজিদ একটি, গোরস্তানও একটি। দুটি মসজিদ কখনোই করতে দেওয়া হয় না। কারণ দুটি মসজিদ হলে গ্রাম ভাগ হয়ে যাবে।

হুলহুলিয়া গ্রামের কৃতি সন্তান

বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার মরহুম মোহাম্মদ হানিফ উদ্দিন মিয়া এই গ্রামের বাসিন্দা। এই হানিফ মিয়ার স্মরণে প্রকাশ করা হয়েছে বিশেষ ডাক টিকিট। গুণী ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন আইন বিভাগের সাবেক সচিব মরহুম এ কে কাদের তালুকদার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মির্জা মনজুরুল কাদের জুয়েল, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম এম এম রহমতুল্লাহ ও নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ইঞ্জি. জমসেদ আলী।

শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল ইউনিটের চেয়ারম্যান ডা. মাহবুবুর রহমান, অস্ট্রেলিয়ার সিডনির সেন্ট্রাল হাসপাতালের ডিন ড. মন্টু তালুকদার ও কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের পরিচালক ড. জিল্লুর রহমান এই গ্রামের বাসিন্দা।

ডিজিটাল হাব

২০১৬ সালে হুলহুলিয়াতে দুই কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ডিজিটাল হাব প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এই ডিজিটাল হাব সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এতে ১১টি কম্পিউটার, একটি প্রজেক্টর, একটি লাইভ টেলিভিশন রয়েছে। এছাড়া একটি ডিজিটাল ইসিজি রুমও রয়েছে। রয়েছে হুলহুলিয়া গ্রামের একটি নিজস্ব ওয়েবসাইট।

হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আল তৌফিক পরশ জানান, ডিজিটাল হাব থেকে সরাসরি গ্রামের মানুষদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ছাত্রছাত্রীদের কম্পিউটার বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। ওয়েবসাইট থেকে এই গ্রামের বিষয়ে তথ্য জানার সুযোগ আছে।

সিংড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মমিনুজ্জামান বলেন, ‘হুলহুলিয়া গ্রামে যদি কোনো ঝামেলা হয়, তাহলে তা তাদের নিজেদের মধ্যে সমাধান করে নেয়। হুলহুলিয়া গ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক।’

এ বিষয়ে সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘শুনেছি হুলহুলিয়া গ্রাম একটি আদর্শ গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সে গ্রামে কোনো মামলা-মোকদ্দমা নেই। নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করেন। এটি একটি আনন্দদায়ক সংবাদ।’

রেজাউল করিম রেজা/এসআর/এএসএম