গ্রামে ঘুরে ঘুরে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন গাইবান্ধার লুৎফর রহমান। উদ্দেশ্য—দরিদ্র পরিবারের শিশুরা যেন পড়ালেখা থেকে ঝরে না পড়ে। এজন্য সম্মানী হিসেবে যা নেন তা খুবই সামান্য। দৈনিক এক টাকা করে নেন লুৎফর রহমান। এজন্য ‘এক টাকার মাস্টার’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন তিনি।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারি ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদের বাঁধের একপাশে লুৎফর রহমানের বাড়ি। গাইবান্ধা শহর থেকে এটি সাত কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। ১৯৭৪ সালে ব্রহ্মপুত্র নদে তার বাড়িঘর, জমিজমা বিলীন হয়ে যায়। উড়িয়া গ্রাম থেকে তিনি এখানে এসে আশ্রয় নেন। ১৯৭২ সালে ফুলছড়ি উপজেলার গুনভরি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। তবে অভাব-অনটনের কারণে তার আর পড়ালেখা করা সম্ভব হয়নি। এখানে এসে তিনি দেখতে পান দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা টাকার অভাবে পড়ালেখা করতে পারছে না। স্কুলে গেলেও লেখাপড়ায় বেশি দূর এগোতে পারে না। প্রাইভেট কিংবা কোচিংয়ের টাকা জোগাড় করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। কারণ এসব পরিবারের বেশিরভাগই দিনমজুর। তাদের পেটের ভাত জোগাড় করাই দুঃসাধ্য, তার ওপর সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালানো অসম্ভব।
এমন শিশুদের যাতে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে না যায় সেজন্য স্কুলের পাশাপাশি পড়ানোর উদ্যোগ নেন লুৎফর রহমান। ১৯৮৪ সাল থেকে তিনি কোমলমতি শিশুদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পড়িয়ে সহযোগিতা করে আসছেন। ১০-১২ জনকে একত্রিত করে পড়ান। এজন্য সম্মানী হিসেবে মাসিক এক টাকা করে নেন তিনি। শুরুতে নিতেন চার আনা করে।
এভাবে বাগুড়িয়া, মদনের পাড়া, ঢুলিপাড়া, কঞ্জিপাড়া, পুলবন্দিসহ বেশ কিছু গ্রামে পায়ে হেঁটেই শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন লুৎফর মাস্টার। এক টাকার বিনিময়ে তিনি এভাবে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ায় তাকে সবাই ‘এক টাকার মাস্টার’ হিসেবে চেনেন। অর্ধশতাব্দী বছর ধরে এভাবেই শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৭২ সালে গুণভরি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন লুৎফর রহমান। কিন্তু চরম দারিদ্র্যের কারণে আর কলেজে ভর্তি হতে পারেননি। তবুও শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি তিনি। নিজের না পাওয়া শিক্ষার কষ্টকে প্রেরণা হিসেবে নিয়ে শিশুদের ঝরে পড়া ঠেকাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ানো শুরু করেন। শুরুতে বিনা পয়সায়, পরে প্রতিদিন মাত্র এক টাকা করে নেওয়া শুরু করেন।
লুৎফর রহমানের পরিবার ছিল সচ্ছল। কিন্তু ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যা ও নদীভাঙনে সব হারিয়ে ওয়াপদা বাঁধের পাশে ছোট্ট একটি টিনের ঘরে আশ্রয় নিতে হয় তাকে। সেখান থেকেই শুরু হয় তার দীর্ঘ সংগ্রামের পথচলা।
বর্তমানে তিনি স্ত্রী লতিফুন বেগম, দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে সেখানে বসবাস করছেন। বড় ছেলে লাভলু অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালান। ছোট ছেলে মশিউর দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স সমমান) সম্পন্ন করেছেন।
প্রতিদিন সকালে বাইসাইকেলে চেপে বা হেঁটে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছুটে বেড়ান লুৎফর রহমান। উদ্দেশ্য একটাই—শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়া। বাগুড়িয়া, মদনেরপাড়া, পুলবন্দি, চন্দিয়া, কঞ্চিপাড়া, মধ্যপাড়া ও পূর্বপাড়াসহ আশপাশের অন্তত ৭-৮টি গ্রামে নিয়মিত ৩০–৪০ জন শিক্ষার্থীকে পড়ান তিনি। কোথাও রাস্তার ধারে, কোথাও গাছতলায় কিংবা বাঁধের ওপর বসেই চলে ক্লাস।
তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী লাবনী আক্তার বলে, ‘স্যার খুব আদর করে পড়ান। আমরা না এলে নিজেই বাড়ি গিয়ে ডাকেন। তার কাছে পড়তে খুব ভালো লাগে।’
আরেক শিক্ষার্থী তানিয়া আক্তার বলে, ‘আমরা প্রতিদিন স্যারকে এক টাকা করে দিই। স্যার আমাদের খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে পড়ান। না বুঝলে বারবার বুঝিয়ে দেন।’
শিক্ষার্থীদের অভিভাবক আমেনা বেগম বলেন, ‘লুৎফর স্যার এই এলাকার গর্ব। এখন এক শিশুকে প্রাইভেটে পড়াতে হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। কিন্তু তিনি নামমাত্র টাকায় বাচ্চাদের শিক্ষা দিচ্ছেন। তার ছাত্ররা এখন অনেকেই বিসিএস কর্মকর্তা ও বিভিন্ন ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন।’
নিজের জীবনের গল্প তুলে ধরে লুৎফর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ম্যাট্রিকের পর অর্থাভাবে কলেজে ভর্তি হতে পারিনি। সেই না পাওয়ার কষ্টই আজও তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই আমি চাই না আমার এলাকার কোনো শিশু পড়াশোনা থেকে পিছিয়ে থাকুক।’
তিনি বলেন, ‘প্রথমে বিনা পয়সায় পড়াতাম, পরে নামমাত্র এক টাকা নিতে শুরু করি। কেউ না দিলেও কিছু বলি না। আমার অনেক ছাত্র এখন ডাক্তার, প্রভাষক, অধ্যক্ষ। ওদের সাফল্যই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।’
বর্তমানে খুব কষ্টের মধ্যে আছেন জানিয়ে লুৎফর রহমান বলেন, ‘অর্থাভাবে দিন কাটাচ্ছি। ঠিকমতো সংসার চালাতে পারছি না, তারপরও শিশুদের এখনো বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে পড়াচ্ছি। শিশুদের পড়াতে গেলেই অভাবের কথা ভুলে যাই। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমার এই কাজ অব্যাহত রাখতে চাই।’
গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ। তিনি বলেন, ‘লুৎফর মাস্টারকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সাধ্য অনুযায়ী সুবিধা দেওয়া হয়। তবে তাকে সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে সহায়তা করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।’
এ বিষয়ে গাইবান্ধা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ আল হাসান বলেন, ‘লুৎফর মাস্টারকে কয়েকবার সহযোগিতা করা হয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী তাকে আরও সহযোগিতা করা হবে।’
এসআর/এমএস