মতামত

বাংলাদেশি পাসপোর্ট শক্তিহীন কেন?

কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহু যুগ আগে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন, ‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখনও বসে বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি, ফিকাহ ও হাদিস চষে।’ প্রশ্ন হলো, এত দশক পর আমরা কি সত্যিই সেই বস্তাপচা মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে পেরেছি? বিশ্বের জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, নীতি ও উন্নয়ন যখন আলোর গতিতে রূপ বদলাচ্ছে, আমরা তখনও প্রায়ই তুচ্ছ, অপ্রাসঙ্গিক কিংবা অনুপযোগী বিতর্কে শক্তি ক্ষয় করি।

আমরা যদি নিজেদের দিকে তাকাই, দেখব—নজরুলের সেই ক্ষোভ আজও পুরোপুরি মুছে যায়নি। আমাদের জাতীয় আলোচনার বড় অংশ আজও সামান্য বিষয় নিয়ে তর্কে ডুবে থাকে, অথচ শিক্ষা–গবেষণা, উদ্ভাবন, আন্তর্জাতিক দক্ষতা, রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা, অভিবাসন সুবিধা, নাগরিক মর্যাদা—এসব মৌলিক প্রশ্ন পেছনে পড়ে থাকে। পরিবর্তিত পৃথিবীতে এগোতে হলে যে বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তি, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আধুনিক নীতি দরকার, আমরা তার অনেকটাই এখনো অর্জন করতে পারিনি। ফলে উন্নয়নচিন্তা ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়ার চক্র আজও চলছে।

পাসপোর্টের উদাহরণই ধরা যাক। বৈশ্বিক র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১০০তম—২০২৪ সালের শুরুতেও যা ছিল ৯৭তম। অর্থাৎ অবনতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত। দুর্বলতম পাসপোর্টের তালিকায় আমরা আছি ৭ নম্বরে। সীমাহীন সম্ভাবনার ১৭ কোটি মানুষের দেশ হয়েও আমাদের নাগরিকরা ভিসামুক্ত ভ্রমণের সুযোগ পান ৩৮টিরও কম দেশে। এর বাস্তব প্রতিক্রিয়া ভয়াবহ—লাখ লাখ ছাত্র, ব্যবসায়ী ও পর্যটকের জীবনে এটি পরিণত হয়েছে দীর্ঘ লাইনের ভোগান্তি, অতিরিক্ত খরচ, আর সীমিত সুযোগের কষ্টকর বাস্তবতায়। বিশ্বের দরজা বাংলাদেশের মানুষের জন্য ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে।

যে-সব দেশে একসময় তুলনামূলক সহজে ভিসা পাওয়া যেত, এখন সেখানে আবেদন মানেই অনিশ্চয়তার অন্ধকার সুড়ঙ্গে হাঁটা। কেউ মাসের পর মাস অপেক্ষায়, কেউ অকারণে রিজেকশন পাচ্ছে, আবার কেউ শেষ মুহূর্তে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছে। স্কলারশিপ পাওয়ার পরও বিদেশে পড়তে যেতে না-পারা শিক্ষার্থীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে—বছরের পর বছর পরিশ্রম, স্বপ্ন আর প্রস্তুতি ডুবে যাচ্ছে দূতাবাসগুলোর নীরবতা আর সন্দেহনির্ভর অভিবাসন নীতির অদৃশ্য দেওয়ালে।

দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী, চাকরিপ্রত্যাশী, পর্যটক, ব্যবসায়ী বর্তমানে বিদেশ যাত্রার ক্ষেত্রে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি। ঘোষণাহীন এই ভিসা–সংকট এখন আর কোনো বিচ্ছিন্ন প্রশাসনিক জটিলতা নয়; এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অভিবাসন–সংস্কৃতির বিবর্তন, আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব, এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার যৌথ প্রতিফলন।

ভারতের ভ্রমণ ভিসা বাদ দিলে বাংলাদেশিদের ওপর আনুষ্ঠানিক কোনো ভিসা নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। যারা নিয়মিত ভ্রমণ করেন তারা জানাচ্ছেন—ইউএই, কাতার, সৌদি আরব, ওমান, বাহরাইন, উজবেকিস্তান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়াসহ বহু দেশ থেকে ভিসা পাওয়া এখন দুরূহ। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের ভিসাও এখন বহু ক্ষেত্রে বিলম্বিত হয় বা রেশিও কমিয়ে ফেলা হয়। এমনকি শ্রীলঙ্কার ই-ভিসাও আগে যেখানে কয়েক মিনিটে হয়ে যেত, এখন তা দুই-তিন দিন সময় নিচ্ছে।

এর কারণ কি শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতা? না, এর শেকড় আরও গভীরে। দীর্ঘদিন ধরে অনেক বাংলাদেশি সহজে পাওয়া ভিসার সুযোগ নিয়ে অন্যান্য দেশে অনিয়মিতভাবে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, নেপাল বা অন্যান্য তুলনামূলক সহজ ভিসা দেওয়া দেশগুলো সেই ভিসা নিয়ে গন্তব্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্য। অভিবাসন কর্তৃপক্ষগুলো এসব তথ্য ও প্রবণতা বহু বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করছে। যখন কোনো দেশের নাগরিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বৈধ ভিসার অপব্যবহার করে অনিয়মিত পথে অন্য দেশে ঢোকার চেষ্টা করে, তখন সেই উৎস দেশকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ তালিকায় ফেলা হয়। ফলে ভিসা পাওয়া কঠিন হয় সবার জন্য—যারা অপরাধী না, তাদের জন্যও।

যে-সব দেশে একসময় তুলনামূলক সহজে ভিসা পাওয়া যেত, এখন সেখানে আবেদন মানেই অনিশ্চয়তার অন্ধকার সুড়ঙ্গে হাঁটা। কেউ মাসের পর মাস অপেক্ষায়, কেউ অকারণে রিজেকশন পাচ্ছে, আবার কেউ শেষ মুহূর্তে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছে। স্কলারশিপ পাওয়ার পরও বিদেশে পড়তে যেতে না-পারা শিক্ষার্থীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে—বছরের পর বছর পরিশ্রম, স্বপ্ন আর প্রস্তুতি ডুবে যাচ্ছে দূতাবাসগুলোর নীরবতা আর সন্দেহনির্ভর অভিবাসন নীতির অদৃশ্য দেওয়ালে।

এই সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করেছে অসাধু দালালচক্র। তারা পর্যটন বা ব্যবসায়িক ভিসা নিয়ে বিদেশে যাওয়ার পর শ্রমিক ভিসায় রূপান্তরের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে মানুষ পাঠায়। অনেকেই সেখানে গিয়ে আটকে যায়, অনেকে পালিয়ে যায়, অনেকে অবৈধ শ্রমিক হিসেবে রয়ে যায়। এতে উৎস দেশের প্রতি অবিশ্বাস বাড়ে। পুরো বিদেশনীতি ও ভিসা নীতি কঠোর হয়ে ওঠে। বিদেশি দূতাবাসের চোখে বাংলাদেশি আবেদনকারীকে তখন আর পর্যটক বা শিক্ষার্থী হিসেবে দেখা হয় না; তাকে সম্ভাব্য ‘ওভারস্টেয়ার’ বা ‘ইমিগ্রেশন রিস্ক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর এই সন্দেহ যত শক্ত হয়, ভিসা–প্রক্রিয়া ততই জটিল হয়।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আরেক নতুন সমস্যা—বিদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মী ও সমর্থকদের প্রকাশ্য সংঘর্ষ। ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকায় বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর বিক্ষোভ, মারামারি, এমনকি দূতাবাস ঘেরাও করার মতো কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর নজরে এসেছে। কোনো দেশই নিজের মাটিতে রাজনৈতিক ঝামেলা আমদানি করতে চায় না। তাই বাংলাদেশিদের ভিসা আবেদন নিয়ে অনেক দেশ অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করছে। বিশ্ব এখন বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রতি সন্দেহপ্রবণ। আমরা নিজেদের যতই যোগ্য মনে করি না কেন, পাসপোর্টই আমাদেরকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ নাগরিক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়।

রাজনৈতিক অস্থিরতাও এর একটি কারণ। অভ্যন্তরীণ অনিশ্চয়তা বেড়ে গেলে বিদেশি কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করে—আবেদনকারী বিদেশে যেতে চাইছে কি বৈধ কারণে, নাকি সে রাজনৈতিক চাপ বা ঝুঁকি থেকে বাঁচতে চায়। এই সন্দেহও ভিসা প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়। ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েন রাজনৈতিক; তাই ভারতীয় ভিসা কবে সহজ হবে, তা বলা কঠিন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার চাইলে বহু দেশকে কূটনৈতিকভাবে বোঝাতে পারত যে অনিয়ম কমাতে তারা কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু এই প্রচেষ্টার দৃশ্যমানতা এখনো খুবই কম।

মাত্র কয়েক হাজার অনিয়মকারী, অবৈধ অভিবাসী, দালালচক্র ও রাজনৈতিক কোন্দল সৃষ্টিকারীদের কারণে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের ভোগান্তি অসীম হয়ে উঠেছে। যে শিক্ষার্থী স্কলারশিপ পেয়েছে, যে ব্যবসায়ী যন্ত্রপাতি কিনতে যাচ্ছে, যে পর্যটক বছরে একবার ঘুরতে বের হয়, যে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার কনফারেন্সে যাচ্ছেন—সবাই এক সারিতে দাঁড়িয়ে একই সন্দেহের বোঝা বহন করছে। এতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের—যারা যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী সুযোগ হারাচ্ছে।

এর সমাধানের পথ দুটি, অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি ও আন্তর্জাতিক আশ্বস্তকরণ। অর্থাৎ প্রথমে নিজেদের ঘর ঠিক করতে হবে, তারপর বিশ্বকে জানাতে হবে যে বাংলাদেশ একটি দায়িত্বশীল, বিশ্বস্ত ও ফলপ্রসূ অংশীদার। অভ্যন্তরীণ সংস্কারের মধ্যে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে—ভিসা–বাণিজ্যকারীদের গ্রেপ্তার করা, ভুয়া এজেন্সি বন্ধ করা, বিদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, মানবপাচার রোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া, এবং অবৈধ অভিবাসনের সাথে যুক্ত নেটওয়ার্ককে দমন করা। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বার্তা যেতে হবে—বাংলাদেশ তার নিজস্ব সমস্যাগুলো বোঝে এবং সমাধানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

একইসঙ্গে শক্তিশালী কূটনৈতিক তৎপরতা অপরিহার্য। বিভিন্ন দেশের অভিবাসন কর্তৃপক্ষের সাথে তথ্য বিনিময়, স্কলারশিপ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ভিসা করিডোর, পর্যটক ও ব্যবসায়ীর জন্য দ্রুত ভিসা চুক্তি, ই–ভিসা সুবিধা সম্প্রসারণ, শ্রমবাজার চুক্তির নবায়ন—এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আস্থা বাড়বে। এটি ধীর প্রক্রিয়া—কিন্তু স্থায়ী সমাধান কেবল এভাবেই সম্ভব।

ভিসা–সংকট আমাদের সামনে এক নির্মম চিত্র তুলে ধরে। আমরা নিজেদের আচরণে, নীতিতে, প্রশাসনিক ব্যবস্থায়, আন্তর্জাতিক যোগাযোগে অনেক ঘাটতি রেখেছি। সেই ঘাটতি এখন বিশ্ব আমাদের সামনে ফিরিয়ে দিচ্ছে। ভিসা আসলে কেবল একটি স্টিকার নয়; এটি বৈশ্বিক আস্থার প্রতীক। যখন একটি দেশের ওপর সেই আস্থা কমে যায়, তখন দরজাগুলো বন্ধ হতে শুরু করে। আমাদের দুর্বলতার মাশুল দিচ্ছে সবচেয়ে যোগ্য তরুণেরা, সবচেয়ে পরিশ্রমী শ্রমিকরা, সবচেয়ে সৎ উদ্যোক্তারা।

একটি দেশের পাসপোর্ট শক্তি নির্ভর করে অর্থনীতি, রাজনৈতিক স্থিতি, বৈশ্বিক ভাবমূর্তি, ভ্রমণকারীদের আচরণ ও পরিচয়পত্রের বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর। বায়োমেট্রিক ই-পাসপোর্ট চালু হলেও সংকটের মূল জায়গাটি প্রযুক্তিগত নয়—কাঠামোগত।

তাই এখনই প্রয়োজন আত্মসমালোচনা ও বাস্তব পদক্ষেপ। দরকার প্রমাণ করা—বাংলাদেশ দায়িত্বশীল, শৃঙ্খলাবদ্ধ, আইনমানা নাগরিকদের দেশ। অল্প কিছু মানুষের অপকর্মের দায় যেন পুরো জাতি না বহন করে—সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে রাষ্ট্রকে।

বিশ্বকে বোঝাতে হবে, আমরা পিছিয়ে থাকতে চাই না। আমরা আস্থার জায়গাটি পুনরুদ্ধার করতে চাই—এবং পারব। একজন সাধারণ বাংলাদেশি কখন সম্মানের সাথে পৃথিবী পেরোতে পারবে—সেই দিনই হবে আমাদের প্রকৃত অগ্রগতির দিন।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম