দেশজুড়ে

বিত্তশালীরা শিল্পবান্ধব না হয়ে ব্যবসাবান্ধব হওয়ায় পিছিয়ে নাটোর

নাটোর একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা, যেখানে কৃষি, চামড়া, মৎস্য ও ফল উৎপাদনে রয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা। দেশের অন্যতম দুধ উৎপাদন এলাকা হিসেবেও পরিচিত এ অঞ্চলটি। তবুও অব্যবস্থাপনা, নীতিনির্ধারকদের দীর্ঘসূত্রিতা ও অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে এ জেলার শিল্প ও বাণিজ্য খাত এখনো কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগোতে পারেনি। নাটোরের ব্যবসা বাণিজ্যের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন নাটোর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আব্দুল মান্নাফ।

জাগো নিউজ: নাটোরে ব্যবসা বাণিজ্যের কী অবস্থা?

আব্দুল মান্নাফ: ভালো নয়। চাঁদাবাজি, সামাজিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ব্যাংক ঋণের জটিলতা ও উচ্চ সুদ হার এর প্রধান কারণ। তবে সরকারের দুটি চিনিকল এবং বেসরকারি কিছু কারখানা রয়েছে। এরা ভালো ব্যবসা করছে।

জাগো নিউজ: নাটোরে শিল্পায়ন না হওয়ার পেছনের মূল কারণ কী?

আব্দুল মান্নাফ: গ্যাস সংকট, চাঁদাবাজি ও বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় মূলত নাটোরে তেমন কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। এছাড়া যারা বিত্তশালী রয়েছেন তারা শিল্পবান্ধব না হয়ে ব্যবসাবান্ধব হওয়ায় শিল্প স্থাপনে একটি বড় বাধা বলে আমি মনে করি।

জাগো নিউজ: বিসিক শিল্পনগরীর কী অবস্থা? আপনি বিসিকে শিল্প সম্প্রসারণের কোনো সুযোগ দেখেন কি না?

আব্দুল মান্নাফ: ১৯৮৭ সালে নাটোরে ১৫ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় বিসিক শিল্পনগরী। উদ্দেশ্য ছিল জেলায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে তুলে কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিকে গতিশীল করা। বাস্তবে আজও এ শিল্পনগরীতে নেই গ্যাস সংযোগ, পানি ও বিদ্যুৎ সেবার স্থায়ী ব্যবস্থা। সড়ক ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাও অপর্যাপ্ত। ফলে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি, উদ্যোক্তারাও আগ্রহ হারিয়েছেন।

আরও পড়ুন-

ভূমিকম্পে কম ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকার উত্তরাঞ্চল, বেশি ঝুঁকিতে দক্ষিণ

‘উদ্যোক্তাদের বৈষম্যহীন ঋণ দিলে জেলায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বাড়বে’

তুরস্কে সুন্দর ক্যারিয়ার ছেড়ে এসেছি গাজীপুরকে সাজাতে

অপরদিকে বিসিকে যে কয়টি প্লট ছিল তা আগেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্লট বরাদ্দের জায়গা না থাকায় নতুন নতু শিল্প উদ্যোক্তারা জায়গা পাচ্ছেন না। ফলে গড়ে উঠতে পারছে না নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান। বিসিক শিল্পনগরীর জন্য বর্ধিত জায়গা অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে বিসিক কেন্দ্রিক নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সুযোগ নেই বললেই চলে।

জাগো নিউজ: নাটোরে একটি বড় কাঁচা চামড়ার বাজার রয়েছে। কিন্তু আস্তে আস্তে বাজার সংকুচিত হয়ে আসছে। এর কারণ কী?

আব্দুল মান্নাফ: নাটোরের চকবৈদ্যনাথ বাজারে প্রতিবছর কোরবানির মৌসুমে কোটি কোটি টাকার চামড়া কেনাবেচা হয়। এটি উত্তরাঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ কাঁচা চামড়ার বাজার। কিন্তু আধুনিক সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ কিংবা বাজার ব্যবস্থাপনা নেই। ফলে স্থানীয় ট্যানারি না থাকায় ব্যবসায়ীরা বাধ্য হন মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে পণ্য ঢাকায় পাঠাতে। এতে দাম কমে যায়, লোকসান গুনতে হয়। এছাড়া ঢাকার ট্যানারি মালিকরা ঠিকমতো টাকা-পয়সা পরিশোধ না করার অভিযোগ রয়েছে। আবার কিছু ব্যবসায়ী টাকা পেয়েও বিভিন্ন স্থান থেকে চামড়া নিয়ে আসা ফড়িয়া ও ব্যবসায়ীদের টাকা পরিশোধ করছেন না। ঈদ মৌসুমে নাটোরের ব্যবসায়ীদের চামড়া কেনার জন্য ব্যাংক কোনো ঋণও দেয় না। এসব কারণে নাটোর চামড়া ব্যবসার বড় বাজার হারাচ্ছে। আমি মনে করি নাটোরে দুই-একটি ট্যানারি গড়ে তোলা হলে চামড়া প্রক্রিয়াজাত ব্যবসায়ীরা লাভবান হতেন।

জাগো নিউজ: নাটোরে কৃষি শিল্প গড়ে তালা সম্ভব কি না? মূল সমস্যা কী?

আব্দুল মান্নাফ: নাটোরের সিংড়া, লালপুর ও গুরুদাসপুরে আম, লিচু, ড্রাগন ফল, মাল্টা, আখসহ নানা কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয়। আখ মাড়াইয়ের জন্য নাটোরে দুটি সুগারমিল রয়েছে। প্রাণ এগ্রা ইন্ডাস্ট্রিজের একডালায় একটি বড় কারখানা রয়েছে। এছাড়া নাটোরে মিল্কভিটা নামে একটি দুধ সংরক্ষণ কারখানা ছিল। যেটি এখন বাঘাবাড়িতে স্থানান্তর করা হয়েছে। প্রচুর মাছ উৎপাদন হয় এখানে। তবে নাটোরে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের সম্ভাবনাকে পুঁজি করে গড়ে ওঠেনি কোনো হিমাগার, ফুড প্রসেসিং সেন্টার কিংবা সাপ্লাই চেইন অবকাঠামো। ফলে কৃষক ও উদ্যোক্তারা প্রতি মৌসুমে পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। এক্ষেত্রে গ্যাসের সরবরাহ না থাকাটাকে আমি বড় অন্তরায় বলে মনে করি।

জাগো নিউজ: নাটোরে কর্মসংস্থান তৈরিতে কী করা যেতে পারে?

আব্দুল মান্নাফ: নাটোরে তরুণ উদ্যোক্তারা সঠিক প্রশিক্ষণ, ব্যাংক ঋণ ও বাজার সাপোর্টের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে। বেকারত্বের হার বাড়ছে। নারীদের জন্য ব্যবসায়িক সহায়তা এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব আরও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা গেলে তাদের কর্মসংস্থানের দরজা খুলে যেত। কিন্তু সেটা হয়নি।

জাগো নিউজ: নাটোরে দুটি অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার কথা ছিল। সেটি কতটা অগ্রসর হয়েছে?

আব্দুল মান্নাফ: বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিয়েছে নাটোরে একটি ইকোনমিক জোন স্থাপনের। তবে বিগত সরকারের আমলে ইকোনমিক জোন স্থাপনের জন্য জায়গা সিলেকশন নিয়ে নেতৃত্বের বিরোধ ও একমত না হওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় অর্থনৈতিক জোন স্থাপনের কাজ। ফলে নাটোরের শিল্প বিকাশ এবং বেকারত্ব সমস্যা সমাধানের সুযোগ হারাচ্ছেন জেলাবাসী।

অপরদিকে লালপুরের পদ্মার চরে একটি অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার কথা আমরা শুনেছিলাম। সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের কয়েকটি টিম ইপিজেড গড়ে তোলার জন্য পর্যবেক্ষণ ও সমীক্ষা রিপোর্ট তৈরি করে। কিন্তু পদ্মা নদী পারাপারের জন্য জায়গাটি অনুকূল নয় এবং উৎপাদন খরচ বেশি পড়বে বলে প্রকল্পটি আটকে যায়। এরপর রাজনৈতিক তৎপরতারতার অভাবে একটি ইকোনমিক জোন এবং একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সম্ভাবনা আটকে যায়।

জাগো নিউজ: নাটোরে শিল্পের দিক থেকে অন্যান্য জেলার চেয়ে পিছিয়ে কেন?

আব্দুল মান্নাফ: নাটোরের বিত্তশালীরা আসলে শিল্পবান্ধব নয় বরং ব্যবসাবান্ধব। তারা বিনিয়োগের সঙ্গে সঙ্গে লাভ চান। কিন্তু শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক ঝুঁকি ও লোকসানের সম্ভাবনা। এসব কারণে তারা শিল্পে বিনিয়োগে পিছিয়ে পড়েছেন।

জাগো নিউজ: নাটোর নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু বলেন?

আব্দুল মান্নাফ: কৃষি ও শিল্প সম্ভাবনার জেলা নাটোর। সমস্যা মূলত পরিকল্পনার ঘাটতি ও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের অভাব। সঙ্গে রয়েছে গ্যাস সরবরাহ না থাকা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস এবং নাটোরের উন্নয়নে একযোগে কাজ না করার মানসিকতা। তবে আশার কথা হচ্ছে, এত প্রতিকূলতার মাঝে অনেক শিল্প উদ্যোক্তা ঝুঁকি নিয়ে কৃষি, ফুড, মাছের খাবার, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প স্থাপনে এগিয়ে আসছেন। অনেকে সফল ও হয়েছেন। আমি মনে করি ঢাকা, চট্টগ্রামে শিল্প স্থাপন না করে নাটোর ভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করতে পারেন। ইপিজেডসহ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলা গেলে নাটোরে প্রচুর কর্মসংস্থান গড়ে উঠবে। এতে ব্যবসা বাণিজ্যের নতুন গতি সঞ্চার হবে। ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও সিভিল সোসাইটি মিলে সমন্বিত উদ্যোগ নিলে নাটোরের চেহারা পাল্টে দেওয়া সম্ভব।

জাগো নিউজ- সময় দিয়ে কথা বলার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আব্দুল মান্নাফ: জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ ও শুভকামনা।

এফএ/জেআইএম