নির্বাচন এলেই রাজনৈতিক দলগুলো জনকল্যাণমুখী নানান কথাবার্তা বেশি বেশি বলতে থাকে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখেও একই ধরনের চিত্র দেখা যাচ্ছে। ভোটের রাজনীতি, জোটের রাজনীতি শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। কিন্তু আসলে জনকল্যাণকে কতটা মাথায় রাখা হয় সেটি এক বিরাট প্রশ্ন। অতীতে দেখা গেছে, কী পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে কিংবা ক্ষমতায় থাকা না থাকার ইস্যুগুলোই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রাধান্য পায়। ফলে জনস্বার্থ উপেক্ষিত হয়। সমঝোতার পরিবর্তে বৈরিতাই স্থান করে নেয় রাজনীতিতে। এ অবস্থা দেশকে এক সংকটজনক অবস্থায় নিপতিত করছে। কিন্তু এ অবস্থা তো কারও কাম্য হতে পারে না। তাই জনকলাণ্যের রাজনীতিই সবার প্রত্যাশা। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতেই হবে।
জনকল্যাণের রাজনীতি হলো এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা দর্শন যেখানে সরকার জনগণের সার্বিক মঙ্গল ও মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য ক্ষমতা দখল নয়, বরং রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়া।
জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিকের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করার নিশ্চয়তা দেয়। বয়স্ক, বিধবা, প্রতিবন্ধী এবং বেকার নাগরিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি (যেমন- পেনশন, বেকার ভাতা) চালু থাকে। হাসপাতাল, ক্লিনিক স্থাপন এবং রোগ প্রতিরোধ ও মাতৃসেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়।
এই ব্যবস্থা সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে কাজ করে এবং সম্পদের সুষম বণ্টনে সহায়তা করে। জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থায় প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের যথেষ্ট জবাবদিহিতা থাকে এবং সুশাসন নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হয়।
আধুনিক রাষ্ট্রগুলোতে জনকল্যাণের রাজনীতি বিভিন্ন রূপে দেখা যায়। উদারনৈতিক মডেলে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ন্যূনতম রাখা হয় এবং বাজারের সমাধানের ওপর জোর দেওয়া হয়। সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক মডেলে করের মাধ্যমে অর্থায়ন করা বিস্তৃত কল্যাণ ব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করে, যা সমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক।
যদিও রাজনীতির মূল লক্ষ্য জনকল্যাণ হওয়া উচিত, তবে সাম্প্রতিক সময়ে অনেক দেশের রাজনীতিতে ব্যক্তিগত লাভ, ক্ষমতা দখল এবং দুর্নীতির কারণে এই মূল উদ্দেশ্যটি ব্যাহত হচ্ছে বলে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। অথচ সশস্ত্র যুদ্ধেও মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া একটি দেশের এই অবস্থা হওয়ার কথা নয়।
জনকল্যাণের রাজনীতি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে সরকার, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এটি কেবল একটি দলের কাজ নয়, বরং একটি সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় দর্শন। এজন্য সরকারের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সবচেয়ে জরুরি। বাজেট বরাদ্দ থেকে শুরু করে প্রকল্পের বাস্তবায়ন পর্যন্ত সব তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ওয়েবসাইট এক্ষেত্রে তদারকি করতে পারে। জনপ্রতিনিধিদের আয়-ব্যয়ের হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। দুদককে হতে হবে স্বচ্ছ। তারা যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।
নির্বাচন কমিশনকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করতে হবে। মানুষ যেন পছন্দের প্রার্থীকে নিরাপদে, নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতির সংকটের মূলে রয়েছে নির্বাচন ব্যবস্থার অস্বচ্ছতা। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারলে জনঅধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে। সেই সাথে জনকল্যাণের রাজনীতির পথও উন্মুক্ত হবে। আমাদের লক্ষ্য হোক সেদিকে।
জনকল্যাণমূলক তহবিল যেন সঠিক কাজে ব্যবহৃত হয়, তা নিশ্চিত করতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে যেন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো বন্ধ না হয়ে যায়, তা নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। আমাদের দেশে দেখা যায়, সরকার পরিবর্তনের সাথে জনকল্যাণমূলক অনেক প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়। এটি করা হয় রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে। আবার রাজনৈতিক কারণেও এমন সব প্রকল্প নেওয়া হয় যেগুলো আসলে জাতীয় স্বার্থের পরিপূরক নয়। এতে রাষ্ট্রীয় অর্থের শ্রাদ্ধ হয়। জনসাধারণও বঞ্চিত হয় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন থেকে।
ধনী-গরিবের মধ্যে আয় ও সম্পদের বৈষম্য কমাতে কার্যকর কর ব্যবস্থা (প্রগতিশীল কর) চালু করা দরকার। করের আওতা বাড়ানো এবং কার্যকর রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহারের জন্য নিজস্ব তহবিল বৃদ্ধি করতে হবে। কর নিয়ে একটি ভীতিকর অবস্থা রয়েছে এখানে। লোকজনকে করজালে বন্দি করে রাখা হয়। একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বার বার কর দিতে হয়। অথচ করযোগ্য লোক বা প্রতিষ্ঠানকে করের আওতায় নিয়ে আসার ব্যাপারে আন্তরিক প্রচেষ্টা লক্ষণীয় নয়। তাছাড়া কর দিলে তার বিনিময়ে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাবে-এই নিশ্চয়তাটুকু না থাকায় করের ব্যাপ্তিও বাড়ে না। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ জরুরি।
মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখে এমন প্রকল্পে (যেমন- স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আধুনিকীকরণ) বেশি বরাদ্দ দিতে হবে। সবার জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি হাসপাতালগুলোর সেবার মান উন্নত করা দরকার। কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্য বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে বাংলাদেশ। এটি ধরে রাখতে হবে।
আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে, যা বেকারত্ব দূরীকরণে সহায়ক হবে। বিশেষ করে কর্মমুখী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের দেশে সার্টিফিকেটসর্বস্ব শিক্ষার জয়জয়কার। যেগুলো আসলে বেকার তৈরির কারখানা ছাড়া আর কিছুই না। দরিদ্র, বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ভাতার পরিমাণ এবং পরিধি বাড়াতে হবে, যাতে কেউ বাদ না পড়ে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তারা যে রাষ্ট্রের বোঝা নয় এই আন্তরিকতাটুকু দেখাতে হবে।
আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিতে বাজেট বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়েছে এবং এর মাধ্যমে দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্যের হার কমাতে সক্ষম হয়েছে। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মতো উদ্যোগগুলো দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে সামাজিক সুরক্ষা বাজেটের একটি বড় অংশ সরকারি কর্মচারীদের পেনশনে চলে যায়, যা দরিদ্রতম মানুষদের জন্য নয়। এছাড়া, অনেক যোগ্য ব্যক্তি এখনো ভাতার আওতার বাইরে রয়ে গেছেন।
দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা দরকার, যেখানে সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে। সবার বিচার পাওয়ার অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে। আইন অঙ্গন যেন টাকার কাছে বন্দি না হয় পড়ে সেটিও দেখতে হবে জরুরিভাবে।
সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে (যেমন- ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা) শক্তিশালী ও স্বাধীন করতে হবে, যাতে তারা নিজ নিজ এলাকার সমস্যা সমাধানে সরাসরি কাজ করতে পারে। তাছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করতে হবে যেন নিজের আয়ে তারা নিজেরাই চলতে পারে। এতে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হবে এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। যে কোনো নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্তে জনগণের মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আসলে জনকল্যাণের রাজনীতি বাস্তবায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এজন্য প্রয়োজন সৎ নেতৃত্ব, জনগণের সচেতনতা এবং সব প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে কার্যকর বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কিছুটা সংকুচিত হওয়ায় জনস্বার্থের বিষয়গুলো যথাযথভাবে উঠে আসছে না। পরিবারকেন্দ্রিক দলীয় রাজনীতি ও ক্ষমতার ব্যক্তিকেন্দ্রীকরণের বাস্তবতায় জনকল্যাণের মূল তত্ত্ব কার্যকর হওয়া কঠিন। সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনকল্যাণের উপাদান কাগজে-কলমে ও কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হলেও, সুশাসন ও দুর্নীতির চ্যালেঞ্জগুলো এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ব্যাহত করছে।
পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। নানান ক্ষেত্রে সংস্কার নিয়ে আসছে অন্তর্বর্তী সরকার, যা পরবর্তী নির্বাচিত সরকারও অব্যাহত রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। এজন্য গণতান্ত্রিক মানসিকতা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য সবার আগে দরকার পরমতসহিষ্ণুতা। দার্শনিক ভলতেয়ারের একটি উক্তি আছে-‘আমি তোমার মতের সাথে একমত নাও হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য জীবনও দিতে পারি’- এই দর্শন ছড়িয়ে দিতে হবে।
নির্বাচন কমিশনকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করতে হবে। মানুষ যেন পছন্দের প্রার্থীকে নিরাপদে, নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতির সংকটের মূলে রয়েছে-নির্বাচন ব্যবস্থার অস্বচ্ছতা। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারলে জনঅধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে। সেই সাথে জনকল্যাণের রাজনীতির পথও উন্মুক্ত হবে। আমাদের লক্ষ্য হোক সেদিকে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর, জাগো নিউজ। drharun.press@gmail.com
এইচআর/এমএফএ/জেআইএম