দেশজুড়ে

পদ্মার তীর সংরক্ষণে ধীরগতি, হারিয়ে যাচ্ছে জমি

পদ্মার ভায়াবহ ভাঙনে গত ছয় বছরে রাজশাহীর পবা ও গোদাগাড়ী এবং চাপাইনবাবগঞ্জের মানচিত্র থেকে মুছে গেছে অন্তত ২৫টি গ্রাম। বড় বড় গ্রামগুলো ভেঙে হয়েছে ক্ষুদ্র। বাগান, ফসলি জমি, বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা প্রতি বছরই নদীতে যাচ্ছে। দুর্গতদের ভাষ্য, পদ্মা তীর সংরক্ষণ করা গেলে তাদের পথে বসতে হতো না। বরাবরই এ অঞ্চলে পদ্মার তীর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই। ভাঙন কবলিত এলাকাগুলোর বেশিরভাগই চরাঞ্চল। আর তাতেই এ অনিহা। আবার যেটুকু কাজ হয়েছে তাও লোক দেখানো। এরই মধ্যে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে জেলার পবা, চারঘাট, বাঘা ও গোদাগাড়ী উপজেলার বহু স্থাপনাসহ অন্তত দশটি গ্রাম। বিজিবি ক্যাম্প ছাপিয়ে পদ্মার ওপারে ভাঙন গিয়ে ঠেকেছে ভারতীয় সীমানা বরাবর। ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে পাশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ১৫টি গ্রাম। ভাঙন কবলিত পবার হরিয়ান ইউনিয়নের চরখানপুরের বাসিন্দা কহিনুর বেগম ও আলেয়া বেগম বলেন, ভাঙন থেকে বাঁচতে একে একে চারবার ঘরবাড়ি ভেঙে সরিয়েছেন তারা। এবারো ভাঙন দেউড়িতে এসে ঠেকায় অন্যত্র সরে যেতে হয়েছে। শেষ আশ্রয়টুকুও নেই এখন তাদের। ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম বাচ্চু বলেন, ভাঙন কবলিত চরখিদিরপুরের দুই মাথার দুই সীমান্ত পিলার নদীতে হারিয়ে গেছে। এখন গ্রামের মাঝ বরাবর দুটি পিলার রয়েছে। পিলার দুটিতে নদী পৌঁছালেই তার ইউনিয়নে পদ্মার দক্ষিণ তীরে বাংলাদেশের মাটি থাকবে না। ওই গ্রামটিতে দেড়শ পরিবারের থাকলেও যে যার মত বাড়িঘর ভেঙে সরিয়ে নিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, রাজশাহী নগরী ঘেঁসা পদ্মার ওপারে তিন দিকে ভারতীয় সীমানা বেষ্টিত চরখিদিরপুর, তারানগর ও খানপুর নামে তিনটি গ্রাম ছিল। সব মিলিয়ে ওই এলাকার আয়তন ছিলো ১ হাজার ৯৪২ হেক্টর। নদী ভাঙনে এরই মধ্যে বিলিন হয়েছে তারানগর ও খানপুর। আর চরখিদিরপুর ছোট হতে হতে গত বছর ঠেকেছে ১৮৭ হেক্টরে। এবারো ভাঙেছে এ ভূখণ্ড।নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে জেলার বাঘার চকরাজাপুর ইউনিয়ন ও গোদাগাড়ীর চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নেও। এরই মধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা। ভিটমাটি হারিয়ে পথে বসেছে হাজারো মানুষ। অন্যদিকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের রানীনগর থেকে নামো হড়মা পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পদ্মায় তীব্র ভাঙন কবলিত। এবারের বন্যায় হড়মা এলাকায় প্রায় দেড় কিলোমিটার ভেঙে পদ্মা ভেতরে ঢুকে গেছে। অব্যাহত ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে ১৫ গ্রাম। ভাঙন কবলিত কোদালকাটি গ্রামের নুর মোহাম্মদ জানান, ছয় বছর আগেও তার ছিল ৩৫ বিঘা ফসলি জমি। ছিলো নিজের বাড়ি, ভিটে মাটি। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরে তিনি সব হারিয়েছেন। পদ্মা নদীর আগ্রাসী আচরণে একের পর এক ভুখণ্ড তলিয়ে গেছে পানিতে। এখন তার নিজের এক ইঞ্চি জায়গাও নেই। শেষ আশ্রয় হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নোম্যান্স ল্যান্ডে। ভাঙন চলতে থাকলে আগামী বছর হয়ত বাংলাদেশি সীমান্তে আর কোনো জমিই থাকবেনা। পাশের দেবীনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বিশ্বাস বলেন, ভয়াবহ নদী ভাঙনে তার ইউনিয়নের অস্তিত্ব বিলীন হবার পথে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের কারসাজি এবং গাফলতিতেই এ জনপদ নদীতে চলে গেলো। উদ্বাস্তু হলো হাজারো পরিবার।রাজশাহী পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালকের দফতর থেকে দেয়া তথ্য মতে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের দেবিনগর ও আলাতুলি এলাকায় পদ্মার বাম তীর প্রতিরক্ষা প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। মোট ৬ হাজার ২২০ মিটার নদী তীর সংরক্ষণে ২২টি প্যাকেজের জন্য বরাদ্দ ছিলো ২৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১২ সালে ৬টি প্যাকেজের টেন্ডার হয়। তবে ঠিকাদাররা কাজ শুরু করে ২০১৪ সালে। নদীর প্রায় ৯০০ মিটার তীর রক্ষার ৬ প্যাকেজের কাজ বন্যার আগে সম্পন্ন হয়েছে বলে পাউবো সূত্র দাবি করেছে। তবে ৬ প্যাকেজের কাজ শেষ হওয়ার পর পরই আলাতুলির রানীনগর এলাকার বাঁধের বিভিন্ন স্থান দেবে গেছে। ধসে পড়েছে বাঁধের নিচের অংশ। পরে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে একই এলাকায় আরো ১২ প্যাকেজের টেন্ডার হয়। এক বছর আগে কার্যাদেশ পেলেও বন্যা শুরুর আগে দু’জন ঠিকাদার নদীর পাড় কাটা শুরু করেন। বন্যার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ভাঙন শুরু হলে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কয়েকশ মিটার এলাকায় ভাঙন ঠেকানো গেলেও এই ১২ প্যাকেজের বেশির ভাগ এলাকায় এখনও ভাঙন চলছে।তবে ১২ প্যাকেজের ৫২ ভাগ কাজ শেষ হবার দাবি করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পাউবোর সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমান। স্থানীয়দের দাবি, কিছু জিও ব্যাগ ও সিসি ব্লক তৈরি ছাড়া কাজের কাজ হয়নি। সর্বশেষ ২০১৬ সালের মার্চে আরো ৬টি প্যাকেজের টেন্ডার হয়েছে। কিন্তু এই পর্বের কোনো কাজই শুরু হয়নি। বিভিন্ন কারণে প্যাকেজগুলো সময়মতো সম্পন্ন হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের পরিচালক পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, এলাকাটিতে যানবাহন চলাচল সহজ নয়। ইট-পাথর-সিমেন্টসহ অন্য উপকরণ প্রকল্প এলাকায় নেয়াও কঠিন। তবে বন্যা নেমে গেলে দ্রুত শেষ কাজ করার তাগিদ দেয়া হবে ঠিকাদারদের।এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলীর দফতর জানায়, এ বছর মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিলো রাজশাহীর ক্যাডেট কলেজ সংলগ্ন পদ্মা বাঁধ সংরক্ষণ, টি-বাঁধ সংলগ্ন পদ্মা বাঁধ সংরক্ষণ, বুলনপুর থেকে সোনাইকান্দি পদ্মা বাঁধ সংরক্ষণ ও টি গ্রোয়েন মেরামত, বাঘা-চারঘাট ও পদ্মার ওপারের সীমান্তবর্তী চর খানপুর-খিদিরপুর পদ্মার বাধ সংরক্ষণ প্রকল্প।এরই মধ্যে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ ও ওই এলাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এর আওতায় ১২শ মিটার তীর মেরামত ছাড়াও ১ হাজার ৮০ মিটার তীর নতুন করে সংরক্ষণ করা হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৭ কোটি টাকা। আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এ কাজ শেষ হবার কথা। এছাড়া রাজশাহী পুলিশ লাইন সংলগ্ন পদ্মার ১৫৭ মিটার বাঁধ স্থায়ী সংরক্ষণ কাজ চলছিলো। বর্ষায় পদ্মায় প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় আপাতত থেমে রয়েছে এক কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে এ কাজ।তবে বাঘা-চারঘাট ও পবার সীমান্তবর্তী চরখানপুর-খিদিরপুর পদ্মার তীর সংরক্ষণ প্রকল্প দুটির আপাতত খবর নেই বলে জানিয়েছেন রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুখলেসুর রহমান। তিনি বলেন, চারঘাটের ইউসুফপুর ও পবার চরখানপুর-খিদিরপুর বিওপি সামনে রেখে পদ্মাতীর রক্ষায় তারা একটি প্রকল্প পাঠিয়েছিলেন মন্ত্রণালয়ে। ২০১৪ সালের ২৩ এপ্রিল এটি মূল্যায়ন কমিটির সভায় যায়। সেখান থেকে অধিকতর যাচাইয়ের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরের বছর ৭ জুলাই মন্ত্রনালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটি দল প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে। পরে ওই কমিটি আপাতত বাঘা-চারঘাট ও পবার সীমান্তবর্তী পদ্মাতীর সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই বলে প্রতিবেদন নেয়। এর ফলে থামকে যায় চর বেষ্টিত এ অঞ্চলের তীর রক্ষা কাজ। তিনি আরো বলেন, নতুন করে বাঘা-চারঘাট এলাকার তীর রক্ষায় প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাবনা তৈরির কাজ চলছে। এছাড়া কয়েকটি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় রাজশাহী শহর রক্ষা বাঁধও ঢেলে সাজানোর প্রস্তুতি চলছে। পদ্মার প্রধান ধারা রাজশাহী শহরের দিকে ধীরে ধীরে বেঁকে আসায় এটির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে জানান তিনি। এফএ/এমএস