রাজধানী ঢাকায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা, আকাশচুম্বি ভবন যেমন বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে সবুজ। ক্রমাগত সবুজ হারানো এই শহরের ফুসফুস হিসেবে পরিচিত রমনা পার্ক ঢাকা শহরের সবুজের এক বড় আশ্রয়।বেশ কিছু দুর্লভ প্রজাতির বৃক্ষ সহ এ পার্কে রয়েছে রমনা পার্কে রয়েছে প্রচুর ঘাস, লতা-গুল্ম, ছোট ও মাঝারি আকারের এবং মৌসুমী ফুলে সমৃদ্ধ গাছ। প্রচুর গাছগাছালির কারণে রমনা পার্কে পাখির আনাগোনাও থাকে বছরজুড়ে চোখে পড়ার মতো।কিন্তু সম্প্রতি এই রমনা পার্কের দুটি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। শুক্রবার রমনা পার্ক ঘুরে দেখা গেছে পার্কের মাঝখানের দিকে একটি কাঠাল ও একটি আকাশী গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।রমনা পার্কে প্রতিদিন ঘুরতে আসেন আজমল হক হেলাল। প্রকৃতিকে খুব কাছে থেকেই দেখতে এখানে আসেন তিনি। এছাড়া এখানকার গাছ, গাছালী, পাখির ছবি তোলা তার শখ। সম্প্রতি রমনা পার্কের দুটি গাছ কাটে ফেলার বিষয়ে তিনি বলেন, রমনা পার্কে দীর্ঘদিন ধরে আমার আসা যাওয়া। এখানকার প্রতিটি স্থানেই আমার পদচারণা আছে, আছে অনেক ভালোবাসাও। ছবি তোলা আমার শখ। আগে প্রচুর পাখির ছবি তুলতাম কিন্তু আস্তে আস্তে পাখিগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে গাছ কেটে ফেলার কারণে।আজমল হক হেলাল বলেন, রমনা পার্কের বর্তমান চেহারা আমাদের দারুণ হতাশ করে। পার্কের সৌন্দর্যহানি ঘটছে। খোঁড়া যুক্তিতে যখন-তখন কেটে ফেলা হচ্ছে গাছ।তিনি বলেন, ভারসাম্য রক্ষা করতে এখানে প্রচুর গাছ দরকার কিন্তু এখানকার গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। পুরাতন কাঁঠাল ও আকাশী গাছ কেটে ফেলা হলো। আমি নিজের উদ্যোগে এই পার্কে গাছ লাগাতে চেষ্টা করেছি কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেই সুযোগ দেয়নি। তারা জানিয়েছেন বাইরের কেউ গাছ লাগাতে পারবে না। অথচ এরাই গাছ লাগানো বাদ দিয়ে গাছ কেটে ফেলছে।শুক্রবার পার্ক ঘুরে দেখা গেছে গাছ কাটা শেষে ডালা পালা ছাটার কাজ করছেন শ্রমিকরা। সেখানে দায়িত্বরতরা জানান, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই গাছ দুটি কাটা হয়েছে। কারণ হিসেবে তারা জানান, গাছ দুটি অনেকটাই মরে গিয়েছিলো, যেকোন সময় গাছ ধসে পরে পার্কে আগতরা দুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারে তাই কাটা হয়েছে।বিভিন্ন সময় রমনা পার্ক নিয়ে কাজ করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (বাপা)। এ বিষয়ে বাপার সাধারণ সম্পাদক ডা. আবদুল মতিন বলেন, গাছ দুটি অনেকটা মরে গিয়েছিলো। তাই সম্ভবত কেটে ফেলা হয়েছে। কাঁঠাল ছাড়া কেটে ফেলা অন্য গাছটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, সেই সব কারণে। পার্ক কর্তৃপক্ষ হয়তিবা গাছটি কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্যদিকে পার্কে নতুন করে গাছ লাগানোর পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।পরিবেশবীদরা মনে করেন, পার্কে অব্যাহতভাবে বিবিধ কনস্ট্রাকশন সবুজকে বিনষ্ট করছে, পার্কে ফুলজ ও নান্দনিক গাছের বদলে বনজ ও ফলদ গাছের বিস্তার বাড়ছে; যা পার্ক হিসাবে রমনার সৌন্দর্য উপযোগিতা ও ঐতিহ্যকে ব্যাহত করছে, বৃক্ষশোভিত স্থান ও ঘাসে ঢাকা উন্মুক্ত স্থানে এবং লনে অপরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানো হচ্ছে।ইতিহাস থেকে জানা যায়, রমনা বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী একটি পার্ক। এটি বর্তমানে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীন রয়েছে। পার্কের বর্তমান আয়তন ৬৮ দশমিক ৫ একর। এর লেকের আয়তন ৮ দশমিক ৭৬ একর। ১৬১০ সালে ঢাকায় মোগলদের শাসন পাকাপোক্ত হওয়ার পর বাগানের অনুরাগী মোগলরা এ উদ্যান তৈরি করেছিলেন। তখন এর নাম ছিল বাগ-ই-বাদশাহি। কোম্পানি আমলে রমনার দক্ষিণের একটি অংশে রেসকোর্স প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস। এক পর্যায়ে ঢাকা থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হলে রমনা এলাকা ক্রমে জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে। মোগল আমলে গড়ে ওঠা রমনা উদ্যান মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে তার সৌন্দর্য হারায়। ঔপনিবেশিক যুগে (১৮২৫ সালে) ঢাকার ইংরেজ কালেক্টর মি. ডস ঢাকা নগরীর উন্নয়নে পদক্ষেপ নেন এবং কারাগারের বন্দীদের দিয়ে রমনার জঙ্গল পরিষ্কার করে বের করেন ডিম্বাকৃতির একটি অংশ।পরিষ্কার করা অংশটিকে কাঠের রেলিং দিয়ে ঘিরে তৈরি করা হয় রেসকোর্স। ইংরেজদের আমলে এই রেসকোর্সের উত্তর-পশ্চিমে একটি টিলাঘর তৈরি করে চারপাশে লাগানো হয় গাছ-গাছালি। এই রেসকোর্সকে কেন্দ্র করেই আবার রমনার আভিজাত্য ফিরে আসে।এএস/এআরএস/পিআর