কৃষিনির্ভর উত্তরের জেলা জয়পুরহাট। এখানে মোট জমির ৮০ শতাংশেই আলু চাষ করেন কৃষকরা। আলু উৎপাদনে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা জয়পুরহাটে এবারও আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। আলু তোলার ভরা মৌসুম শুরু না হলেও আগাম জাতের আলুতে ইতোমধ্যে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। কিন্তু দিন দিন আলুর দাম কমে যাওয়ায় চিন্তিত কৃষকরা। এদিকে আগাম জাতের আলু গাছ ভালো হলেও হঠাৎ করে ঘন কুয়াশা আর প্রচণ্ড শীতে জয়পুরহাট জেলার আলুখেতে দেখা দিয়েছে নাবিধসা (লেটব্রাইট) রোগ। জমিতে আক্রমণের ৩/৪ দিনের মধ্যে গাছের পাতা ও কাণ্ড পচে পুরো খেত মরে যাচ্ছে। কিটনাশক প্রয়োগ করেও প্রতিকার মিলছে না। বরং দিন দিন তা বিস্তার লাভ করছে এক জমি থেকে অন্য জমিতে। বার বার কিটনাশক প্রয়োগ করেও রোগ সাড়াতে না পেরে ফলন বিপর্যয়ে লোকসানের আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। জয়পুরহাটে আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অনুপাতে বিএডিসি কৃষকদের চাহিদা মতো আলুবীজ সরবরাহ করতে না পারলেও বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির কাছ থেকে আলুবীজ সংগ্রহ করে কৃষকরা তাদের চাহিদা পূরণ করেছে। ফলে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও বেশি দামে আলুবীজ সংগ্রহ করতে বাধ্য হয়েছেন কৃষকরা। তবে সার ও ডিজেলের দাম ছিল কৃষকের নাগালের মধ্যে। গত বছর মৌসুমের শুরুতে দাম না পেলেও পরবর্তীতে আলুর ভালো দাম পাওয়ায় আশান্বিত হয় ওঠেন আলু উৎপাদনে বৃহত্তম জয়পুরহাট জেলার কৃষকরা। ফলে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অধিক লাভের আশায় এবার অধিকহারে আলু চাষে ঝাঁপিয়ে পড়েন চাষিরা। জেলায় এবার ৪০ হাজার ৭৩৫ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আলুর চাষ হয়েছে ৪২ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৭৯৫ হেক্টর বেশি। এর মধ্যে আগাম জাতের আলুর চাষ হয়েছে ১০ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে এবং জেলায় এবার আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৯ লাখ মেট্রিক টন।উপজেলা ভিত্তিক এবার আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল জয়পুরহাট সদরে ৭২০০ হেক্টর, পাঁচবিবিতে ৭৩০০ হেক্টর, আক্কেলপুরে ৫২০০ হেক্টর, ক্ষেতলালে ৯০৩৫ হেক্টর ও কালাই উপজেলায় ১২০০০ হেক্টর জমি। জয়পুরহাট জেলায় মূলত কার্ডিনাল, ডায়মন্ড, চকুরি, হাইব্রিড গ্যানোলা, ম্যানোলা, রুমানা, বট পাকরি, ফাটা পাকরি, তেল পাকরি, লরা, ক্যারেজ, লেডিস রোজেটা, পাহাড়ি, প্রবিন্ড, এ্যাসস্টিক, ক্যারেট, স্থানীয় তিলকপুরী ও ভান্ডারপুর জাতের আলু উৎপাদন হয়।জয়পুরহাট সদরের বম্বু গ্রামের কৃষক মোফাজ্জল হোসেন, ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের কৃষক আমজাদ হোসেন, আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর গ্রামের কৃষক লোকমান মিয়া, কালাই উপজেলার আহম্মেদাবাদ, মাত্রাই, উদয়পুর, পুনট ও জিন্দারপুর ইউনিয়নের একাধিক কৃষক জানান, প্রতি বিঘা জমিতে হাইব্রিড গ্যানোলা ও ম্যানোলা জাতের আলু ১১০ থেকে ১২০ মণ, কার্ডিনাল, ডায়মন্ড, রুমানা, বট পাগড়ী, লেডিস রোজেটা জাতের আলু ৭০-৮০ মণ, পাহাড়ি ৬০-৭০ মণ, প্রবিন্ড ৬৫-৭০ মণ এবং দেশি জাতের আলু ৬০-৬৫ মণ উৎপাদন হয়েছে। আলু উৎপাদনের জন্য এবার কৃষকদের জমি লিজসহ, বীজ, জমি চাষ, সার-ওষুধ, সেচ, নিড়ানী ও বাঁধাই, আলু উত্তোলনসহ প্রতি বিঘা (৩৩ শতক) জমিতে চাষিদের উৎপাদন খরচ হয়েছে গড়ে ১২-১৫ হাজার টাকা। জয়পুরহাট কালাই উপজেলার পুনট বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়ৎদার আলী আজগর, জয়পুরহাট পৌর এলাকার নতুনহাট বাজারের পাইকারি বিক্রেতা আহম্মদ হোসেন, মাছুয়াবাজারে খুচরা আলু বিক্রেতা বদিউজ্জামানসহ জেলার অনেক আলু বিক্রেতা জানান, নতুন আলুর সরবরাহ বাড়ায় আলুর দাম কমতে শুরু করেছে। নতুন আলু বাজারে আসার পাশাপাশি পুরোনো আলুর সরবরাহও কমে গেছে। পুরোনো আলুর মজুদ গত মাসেই ফুরিয়ে গেছে। একদিকে পুরোনো আলুর সরবরাহ কমেছে, অন্যদিকে নতুন আলুর সরবরাহ চাহিদা অনুযায়ী বাড়েনি। ফলে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে বাজারে আলুর দাম বাড়তে শুরু করে। এখন সরবরাহ বাড়ায় দিন-দিন আলুর দাম কমতে শুরু করেছে। ফেব্রুয়ারি-মার্চে আলুর মূল ফলন উঠতে শুরু করলে দাম আরও কমে যেতে পারে বলে তারা আরও জানিয়েছেন। জয়পুরহাটের বাজারে ডিসেম্বরে প্রতি মণ ক্যারেজ আলু ৮০০ টাকা, কার্ডিনাল ৮০০ টাকা, ডায়মন্ড ৬০০ টাকা, হাইব্রিড গ্যানোলা ৫০০ টাকা, রুমানা ৮০০ টাকা, বট পাকরি, ফাটা পাকরি, তেল পাকরি ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা বিক্রি হয়েছে। সেই আলুই এক মাসের ব্যবধানে আলুর দাম প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে জয়পুরহাটের বাজারগুলোতে যে আলু সর্বোচ্চ ৩০-৪০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছিল, তা নেমেছে সর্বনিম্ন ১০-১২ টাকায়। তবে বর্তমান বাজারে আলুর মূল্য মোটামুটি ভালো। প্রতি মণ আলু জাতভেদে পাইকারি বাজারে গড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা দরে। খুচরা বাজারে তা ৪৫০-৪৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এইভাবে বাজার থাকলে কৃষক ১০-১২ হাজার টাকা বিঘাপ্রতি আলুতে লাভ করতে পারবেন। জয়পুরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (শস্য) আবু হোসেন জানান, আলু স্বল্পমেয়াদি ফসল। গত মৌসুমে আলু চাষ করে কৃষকরা প্রচুর লাভবান হয়েছিল। এবার জয়পুরহাটে ৪২ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে, যা অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এবার আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে এবং কৃষক আলুতে বেশ ভালো দামও পাচ্ছেন বলে তিনি জানিয়েছেন। এমএএস/জেআইএম