দেশজুড়ে

তামাকের কারণে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহে বাড়ছে যক্ষা রোগী

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আরজেল আলী। তামাক প্রকিয়াজাতের সাথে আছেন দশ বছর ধরে। তামাকের বিষাক্ত গন্ধ আষ্টেপিষ্টে ধরেছে তাকে। খুশখুশে কাশিও কাবু করেছে আরজেল আলীকে। এরপরও জীবীকার তাগিদে, এই পেশা থেকে সরে আসতে পারছেন না তিনি। ৭ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ায়, ৩ সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে, এক প্রকার বাধ্য হয়েই ঝুকিপূর্ণ এ পেশা বেছে নিয়েছেন রইজান খাতুন।আরজেল আলী ও রইজান খাতুনের মত অসংখ্য শ্রমিক রয়েছেন, তামাকের সাথে যাদের নিত্যদিনের উঠাবসা। আশংকার বিষয়, তামাক প্রক্রিয়াজাতের সাথে জড়িয়ে পড়ছে শিশুরাও।তামাকের সাথে জড়িত শ্রমিকরা আক্রান্ত হচ্ছেন, নানা জটিল রোগে। যার একটি যক্ষা। দেশের সবচেয়ে বেশি তামাক উৎপাদনকারী জেলা কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ।  তাই এখানে যক্ষায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বেশি। কুষ্টিয়ায় এক তৃতীয়াংশ তামাক উৎপাদন হয় মিরপুর ও দৌলতপুর উপজেলায়। যে কয়েকটি কারণে যক্ষা রোগী বাড়ছে, তার মধ্যে তামাক জনিত কারণ অন্যতম। এফসল চাষ থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণে যারা নিয়োজিত, তাদের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। দেশের সবচেয়ে বেশি তামাক উৎপাদনকারী জেলা কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ তাই যক্ষা রোগীর সংখ্যাও বেশি।এ ভয়াল চাষে জড়িয়ে পড়েছে এলাকার নারী, শিশু ও কিশোররা। এদিকে তামাক চাষ থেকে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে কৃষি অফিস কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।জানা গেছে, ঝিনাইদহ জেলার বেশির ভাগ উর্বর জমি এখন বিভিন্ন তামাক কোম্পানির দখলে। জেলাজুড়ে প্রায় এক হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে চাষ হচ্ছে তামাক। আর জেলার দুই হাজার ২০০ কৃষক তামাক চাষে জড়িত। এছাড়া এ কাজে শ্রমের মূল্য অধিক হওয়ায় কৃষকরা তাদের পরিবারের নারী, শিশু ও কিশোরদের এ কাজে ব্যবহার করছেন। বিশেষ করে যে বয়সে শিশু-কিশোরদের স্কুলে যাওয়ার কথা সে বয়সে তারা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে বাড়ছে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি।সরেজমিন দেখা গেছে, জেলার বিভিন্ন এলাকায় নারী, কিশোর ও শিশুরা তামাকের বীজতলা থেকে চারা উত্তোলন, চারা রোপণ, আগাছা পরিষ্কার, বিষ দেয়া, পোড়ানো এমনকি তামাক বাজারজাতকরণের কাজে সহায়তা করছে। যাদের অর্থের বিনিময়ে শ্রম কেনার সামর্থ্য নেই সেই অভিভাবকরা তাদের নারী ও সন্তানদের এসব কাজে বেশি ব্যবহার করছেন।অভিভাবকরা জানান, তামাক মৌসুমে মাঝে মধ্যে স্কুলে যায় তাদের শিশুরা। এই সময়ে স্কুলে গেলে লেবার নিয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু লেবারের মজুরি দেয়ার সামর্থ্য না থাকায় তারা পরিবারের নারী, শিশু ও কিশোরদের এ কাজে ব্যবহার করছেন। অভিভাবকরা আরও জানান, তামাক চাষে স্বাস্থ্যঝুঁকি জানার পরও অন্যান্য রবি শস্যের তুলনায় দাম বেশি হওয়ায় তারা এটি চাষে জড়িয়ে পড়ছেন।এদিকে জেলার ১৩ শতাধিক কৃষক ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ‘বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেড’ (বিএটিবি) এর সঙ্গে তামাক চাষে চুক্তিবদ্ধ বলে জানা গেছ। চুক্তিবদ্ধ কৃষকরা বীজ, সার ও কীটনাশক কোম্পানির কাছ থেকে ঋণ হিসেবে পান। তাই কৃষকদের তামাক চাষে তেমন বিনিয়োগ করতে হয় না।ফলে অধিক মুনাফার জন্য কৃষকরা তামাক চাষ করছেন।ঝিনাইদহের শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অলোক কুমার সাহা জানান, তামাকের কাজ করার ফলে শিশু-কিশোররা গ্রিন ট্যোবাকো সিনড্রোম রোগে আক্রান্ত হয়। একদিন কাজ করলে ৫৪ মিলিগ্রাম নিকোটিন দেহে শোষণ করে যা ৫০টি সিগারেট পানের সমান ক্ষতি করে। ফলে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসায় যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয় তা তামাক কাজের আয় থেকে অনেক বেশি।ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. জয়নুল আবেদীন জানান, ঝিনাইদহে আগে তামাক চাষ কম হতো কিন্তু বিভিন্ন কোম্পানি চাষের উপকরণসহ নগদ টাকা ও লোভনীয় প্রস্তাব দেয়ায় চাষাবাদ বেড়ে গেছে। তবে কৃষি অফিস তামাক চাষে কৃষকদের সবসময় নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করছে বলে জানা যায়। প্রতিবেদনটি তৈরীতে সহায়তা করেছে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ প্রতিনিধি।এসএইচএ/আরআইপি