উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জয়পুরহাট জেলা আধুনিক হাসপাতাল ১০০ শয্যা থেকে ২০১৩ সালের ১ জানুয়ারি ১৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। তবে বর্ধিত ৫০ শয্যার জন্য এখনো সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে আলাদা কোনো জনবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। ফলে পূর্বের কাঠামোর জনবল দিয়েই ১৫০ শয্যার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এতে করে জনবল সংকটসহ নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত হাসপাতালটি। এক সময়ে দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকারী ১৫০ শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতাল। হাসপাতালটি জেলার প্রায় ১২ লাখ ও পার্শ্ববর্তী ৬-৭ টি উপজেলার আরও ৪ লাখ মানুষের একমাত্র আধুনিক চিকিৎসার ভরসাস্থল হলেও সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এদিকে জয়পুরহাট জেলার রোগী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী নওগাঁ জেলার ধামুইরহাট, পত্নীতলা, বদলগাছী, দিনাজপুর জেলার হাকিমপুর, বিরামপুর, ঘোড়াঘাট এবং গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা থেকে প্রতিদিন অসংখ্য রোগী চিকিৎসার জন্য এ হাসপাতালে আসেন। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে বহির্বিভাগে শিশু, নারী-পুরুষ মিলে মোট এক হাজার জন রোগী সেবা নিয়ে থাকেন ও অন্তঃবিভাগে ২৩৩ জন রোগী ভর্তি হন। হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট থাকায় দিন দিন ভেঙ্গে পড়ছে এখানকার চিকিৎসাসেবা। গ্রেড অনুসারে এ হাসপাতালে ১৯৬ জন থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে এখানে কর্মরত রয়েছেন ১৬২ জন। এতে শূন্য পদ ৩৪ টি। হাসপাতালের প্রথম শ্রেণির জনবল অনুমোদিত রয়েছে ৪৫ জন। যেখানে কর্মরত রয়েছেন ২৯ জন। এখনোও শূন্যপদ ১৬টি। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটিতে গুরুত্বপূর্ণ জুনিয়র কনসালটেন্ট (নাক-কান-গলা), জুনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু), জুনিয়র কনসালটেন্ট (অ্যানেসথেসিয়া), জুনিয়র কনসালটেন্ট (যৌন-চর্ম) পদ শূন্য রয়েছে।এছাড়াও মেডিকেল অফিসার ১৩ টি পদের মধ্যে একটি পদ শূন্য, ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসারের সাতটি পদের মধ্যে পাঁচটি শূন্য, মেডিকেল অফিসার (অ্যানেসথেসিয়া), মেডিকেল অফিসার (প্যাথলজিস্ট), মেডিকেল অফিসার (রেডিওলজিস্ট), মেডিকেল অফিসার (রক্ত পরিসঞ্চালন), মেডিকেল অফিসার (আবাসিক) একটি করে এবং জুনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মকর্তা দুইটি পদের মধ্যে দুইটিই শূন্য রয়েছে, স্টাফ নার্স ৪০টি পদের মধ্যে ৪টি পদ শূন্য।দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৭৬ জনের মধ্যে কর্মরত আছেন ৭২ জন, তৃতীয় শ্রেণির ২৭টি পদের মধ্যে ২৪ জন ও চতুর্থ শ্রেণির ৪৮ জনের মধ্যে কর্মরত রয়েছেন ৩৭ জন। ফলে এসব শূন্যপদ নিয়েই চলছে জয়পুরহাট আধুনিক জেলা হাসপাতালের প্রতিদিনের চিকিৎসা ব্যবস্থা। জেলা হাসপাতালে নেই কোনো ব্লাড ব্যাংকের ব্যবস্থা। ফলে রক্তের জন্য রোগীদের বিভিন্ন জনের কাছে ধরনা দিতে হয়। হাসপাতালে কোনো রকম জটিল রোগের চিকিৎসা এবং অস্ত্রোপাচারের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিনিয়ত জটিল রোগীদের বগুড়া ও ঢাকাসহ জেলার বাইরে পাঠানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাব ও নতুন জন্ম নেয়া অপ্রাপ্ত-বয়স্ক শিশুদের ইনকিউবেটরের অভাবে অকালে মৃত্যু হচ্ছে। সপ্তাহে দুইদিন প্রসূতি মাসহ অন্যান্য রোগীদের অপারেশন ব্যবস্থা থাকায় রোগীরা কালক্ষেপণ না করে বিভিন্ন ডাক্তারের পরামর্শে বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে রোগীদের অপারেশন করান। এতে করে গরীব রোগীদের অনেক আর্থিক ক্ষতির সন্মুখীন হতে হচ্ছে। হাসপাতালে ডিজিটাল এক্সরে-মেশিন ও বিভিন্ন রকম জটিল প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা না হওয়ায় ডাক্তারের পছন্দমত ল্যাবে গিয়ে পরীক্ষা করাতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীরা। হাসপাতালে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজের জন্য বর্তমানে একজন সুইপার কর্মরত থাকায় অস্থায়ী সুইপার দিয়ে হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে হয়। দুইটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও তা চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এছাড়াও অ্যাম্বুলেন্সগুলো ৬০-৭০ কি. মি. পর্যন্ত যাতায়াত করে। ফলে রোগীদের ব্যক্তি মালিকাধীন অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে প্রয়োজন মেটাতে হয়। এদিকে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীরা প্রয়োজনীয় বেড না পেয়ে মেঝেতে গাদাগাদি করে অবস্থান নিয়ে কোনোমতে চিকিৎসাসেবা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। হাসপাতালে পা ভাঙার চিকিৎসা নিতে আসা পাঁচবিবি উপজেলার বাগড়ি গ্রামের জেসমিন আক্তার ও টাইফয়েডে আক্রান্ত জয়পুরহাট সদর উপজেলার মাধাইনগর গ্রামের মাহি আক্তার বলেন, ডাক্তার তার পছন্দমত ল্যাব থেকে পরীক্ষা করে আনতে বলেছে , সে অনুযায়ী আমরা পরীক্ষাগুলো করে এনেছি।জয়পুরহাট সদর উপজেলার মাধাইনগর গ্রামের নয়নতারা বেগম ও আক্কেলপুর উপজেলার রওশন আরা জানান, আমাদের সিজারিয়ান অপারেশন করার সময় দুই হাজার ৫০০ টাকার ওষুধ বাহির থেকে কিনতে হয়েছে।জয়পুরহাট সদর উপজেলার দুর্গাদহ এলাকার আদিবাসী সোহাগী মনি বলেন, ডাক্তার সিজার করার পর আমার বাচ্চা অপ্রাপ্ত-বয়স্ক হওয়ার কারণে বগুড়ায় নিয়ে যেতে বলেছিল কিন্ত অর্থের অভাবে বগুড়ায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে তার বাচ্চাটি বাঁচেনি বলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। জেলা আধুনিক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. খুরশীদ আলম জানান, হাসপাতালটি ১৫০ শয্যাই উন্নীত করা হলেও সে অনুপাতে সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়নি।তবে বিভিন্ন জায়গা থেকে ডাক্তারদের সমন্বয় করে চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আরএআর/এমএস