দেশজুড়ে

টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে ৩ মানব পাচারকারী নিহত

টেকনাফ মহেষখালী পাড়ায় শুক্রবার সকালে পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে মারা গেছেন তালিকাভুক্ত তিন পাচারকারি। তাদের বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগে দেড় ডজন মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। পাচারকারি নিহতের খবর এলাকায় জানাজানি হওয়ার পর মালয়েশিয়ার পথে বেরিয়ে নিখোঁজ পরিবারের লোকজন শোকরিয়া জ্ঞাপন করেছেন। এলাকাবাসীরা জানান, থাইল্যান্ডের জঙ্গলে পাওয়া গণকবর সবার বিবেককে নাড়া দিয়েছে। খেটে খাওয়া মানুষের অভাবকে পুঁজি করে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া মানব পাচারকারিদের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছে সবাই। নড়েচড়ে বসছে আইন প্রয়োগকারি সংস্থাও। তালিকাভুক্ত চিহ্নিত মানবপাচারকারিদের ধরতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে তারা। এমনই এক অভিযানে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আতাউর রহমান খন্দকার জাগো নিউজকে বলেন, শুক্রবার ভোরে চিহ্নিত মানবপাচারকারিদের ধরতে টেকনাফ মহেষখালী পাড়ায় অভিযান চালানো হয়। এসময় তারা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালান। আত্মরক্ষার্থে পুলিশও পাল্টা গুলি চালালে বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এসময় গুলিবিদ্ধ হন শাহ পারীর দ্বীপ বাজার পাড়ার মৃত সোলতান আহমদের ছেলে ধলু হোসেন ৫৫), সাবরাং কাটাবনিয়ার আবদুল মাজেদের ছেলে জাহাঙ্গীর আলম (৩০) ও হারিয়াখালীর কবির আহমদের ছেলে জাফর আলম (২৫)। তাদেরকে উদ্ধার করে উপজেলা হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মানবপাচারকারী এবং তাদের বিরুদ্ধে মানব পাচারের একাধিক মামলাও রয়েছে।তিনি আরো বলেন, বিবেকের দংশন প্রশমন ও করুণ মৃত্যুর শিকার হতভাগাদের আত্মার প্রশান্তি কল্পে চিহ্নিত মানবপাচারকারিদের আইনের আওতায় আনতে আমরা তৎপরতা চালাচ্ছি। এ ঘটনায় তিনিসহ (ওসি), পরিদর্শক (তদন্ত) কবির হোসেন, উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম ও কনস্টেবল আব্দুল বারি আহত হয়েছেন। তারাও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।তিনি আরো বলেন, নিহত ধলু হোসেনের বিরুদ্ধে ২০টি, জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ৮টি ও জাফরের বিরুদ্ধে ২টি মানবপাচারের মামলা রয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে দুটি দেশীয় এলজি, ১০টি গুলির খোসা ও তিনটি তাজা গুলি উদ্ধার করা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। থাইল্যান্ডের জঙ্গলে নিহত ঈদগাঁওর কলেজ পল্লীর বেলাল উদ্দিন অকির (৩০) মা নুরজাহান বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ছেলে হারানোর যন্ত্রণা কাউকে দেখাতে পারছি না। তার (বেলালের) তিন সন্তান ও তরুণী স্ত্রীর মুখ দেখলে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। আমার মরদেহ যে ছেলের কাধে করে কবরে নেয়ার কথা ছিল, সে ছেলের করুণ মৃত্যু আমাকে ভারাক্রান্ত করে। মৃত্যুর পর আমার ছেলের নিথর দেহটাও একটু ছুঁয়ে দেখা সম্ভব হয়নি মানব রূপী এসব হায়নাদের কারণে। আমার ছেলেকে আটকে রেখে তারা ২ লাখ টাকা চেয়েছিলেন। টাকা না দিলে ছেলেকে মেরে ফেলা হবে বলে জানিয়ে হুমকি দেন তারা। সে হুমকি সত্যি করে অকালে আমার বুক খালি করলো এ অমানুষগুলো। তিনি আরো বলেন, শুনেছি পাচারকারি দলের তিনজন পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধে মারা গেছেন। আমার ছেলের মৃত্যুর খবর যেভাবে আমাকে কষ্ট দিয়েছিল, আজ এ মৃত্যুর খবর আমাকে তেমনি করে আনন্দিত করেছে। তবে জানিনা কাদের হাতে আমার ছেলে মারা গেছে। যার হাতেই মারা যাক, দালাল সবতো একই পথের পথিক।দালালের হাত ধরে মালয়েশিয়ার পথে বেরিয়ে দীর্ঘ দুই বছর ধরে নিখোঁজ একই এলাকার নাছির উদ্দিনের বাবা বদি আলম মাঝিসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য নিখোঁজ ব্যক্তির অভিভাবকরাও একই অভিমত দিয়েছেন। পাচারের বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়ে নানাভাবে বিরক্ত জেলার উপকূলের অনেক জন প্রতিনিধিও মানবপাচারকারি নিহতের ঘটনায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আইন প্রয়োগকারি সংস্থার এ কঠোরতা আরো আগে দেখানো উচিত ছিল মন্তব্য করে টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র আবদুল্লাহ মনির জাগো নিউজকে বলেন, মালয়েশিয়ার পথে বেরিয়ে নিখোঁজ অনেক ব্যক্তির পরিবারের লোকজন ফোন  করে তাদের প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, সব মৃত্যু কষ্টকর হলেও এ মৃত্যু সংবাদ তাদের খুশি করেছে। তাতে মনে হয়েছে, শুধু কক্সবাজার নয়, সারা দেশে বিভিন্ন এলাকার নিখোঁজ লোকজনের পরিবারে এ সংবাদ তাদের প্রিয়জন হারানোর ব্যাথা একটুখানি হলেও প্রশমন করবে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, শুরু থেকেই পুলিশ মানবপাচার রোধে অব্যাহত অভিযান চালিয়ে এসেছে। উদ্ধার করেছে সহস্রাধিক পাচার ভিকটিম। এসময় ৩৫ দালালকে আটক করে তাদের বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা করা হয়। গত ৬ মে টেকনাফ, উখিয়া ও কক্সবাজার সদরে অভিযান চালিয়ে ৬ পাচারকারিকে আটক করেছে পুলিশ। আটকদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, বিশেষ করে থাইল্যান্ডের গণ-কবরের ঘটনা মানবিকতায় কঠোর আঘাত করেছে। সবার মতো আমাদেরও চাওয়া পাচারকারিরা আইনের আওতায় আসুক। টেকনাফ থেকেই এর যাত্রা শুরু হয়েছে। যতই প্রতিবন্ধকতা আসুক সব পাচারকারিদের পাকড়াও করেই পুলিশ ক্ষান্ত হবে। বিজিবি কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল মো. খালেকুজ্জামান বলেন, সীমান্তের অতন্ত্র প্রহরী হিসেবে বিজিবি পাচার রোধে প্রানান্ত চেষ্টায় দায়িত্ব পালন করছে। সম্প্রতি পাচার ভিকটিম ও পাচারকারি আটক করতে গিয়ে বিজিবির এক সদস্য হাতির আক্রমণে নিহত হয়েছেন। এতে বোঝা উচিত পাচার রোধে বিজিবি প্রাণ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না। তিনি আরো বলেন, গত ৬ মাসে বিজিবি সদস্যরা উপকূলীয় এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৭৮ জন মালয়েশিয়াগামী যাত্রীকে উদ্ধার করেছে। এসময় ৩৫ দালালকে আটকের পর থানায় সোপর্দ করে তাদের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে ৩০টি মামলা রুজু করে। পালিয়ে যাওয়া আরো ২৪ দালালের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে। আমরাও চাই পাচার বন্ধ হয়ে মানবতার অবক্ষয় রোধ হোক। সায়ীদ আলমগীর/এমজেড/এমএস