দেশজুড়ে

যশোরের ‘মাছ নান্নু’ এখন ভাগ্য বদলের দিশারী

স্নাতক পাস করে শিক্ষকতা শুরু করলেও তাতে মন বসেনি আনোয়ার হোসেন নান্নুর। স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্নে প্রায় দুই যুগ আগে পথে নামেন তিনি। মাত্র চার হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। বর্তমানে বছরে তিনি প্রায় চার কোটি কার্প জাতীয় মাছের পোনা উৎপাদন করছেন। যার বাজার মূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। যশোর সদর উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের মালিডাঙ্গা গ্রামের নান্নুর আদর্শ মৎস্য খামারটি এখন সত্যি সত্যি আদর্শেরই প্রতীক। আর আনোয়ার হোসেন নান্নুকে এখন দশ গ্রামের লোক মাছ নান্নু নামে চেনেন। নান্নুর বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়ায়। স্নাতক পাস করে তিনি ২৮৮ টাকা বেতনে একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু এই টাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল তাকে। এক পর্যায়ে স্কুলের চাকরি ছেড়ে মাছ চাষে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখেন তিনি। সেটা ১৯৯২ সালের কথা। মাত্র চার হাজার টাকা নিয়ে পথে নামেন নান্নু। চলে আসেন যশোর শহরতলীর চাঁচড়া মৎস্য পল্লিতে। এখানেই ছোট একটি পুকুর নিয়ে শুরু করেন মাছ চাষ। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে তিনি যশোর শহর থেকে ১৪ কিমি দূরে মালিডাঙ্গা গ্রামে কাজী তৌহিদুর রহমানের কাছ থেকে ২০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে পুকুর কেটে মাছ চাষ শুরু করেন। গ্রামে তিনিই প্রথম মাছ চাষের গোড়াপত্তন করেন। অল্প দিনের ব্যবধানে মাছ চাষে অসামান্য সাফল্যের কারণে তিনি মাছ নান্নু নামে এলাকায় পরিচিতি লাভ করেন। এখন নান্নু গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে গ্রামের পাঁচ-দশজন যুবক তার পিছু পিছু হাঁটেন আর কাহিনী শোনেন। নান্নু জানান, জঙ্গলঘেরা এই গ্রামে কোন ফসল ফলত না। সেই গ্রামের পরিত্যক্ত জমিতে পুকুর কেটে মাছ চাষ করে তিনি গ্রামের খোল নলচে বদলে দিয়েছেন। নিজে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। পাশাপাশি গ্রামের বেকার সমস্যা দূর করেছেন। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, যশোর সদর উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের মালিডাঙ্গা গ্রামের নান্নুর আদর্শ মৎস্য খামারে লাফালাফি করছে রুই, কাতলা, মৃগেল, মনোসেক্স তেলাপিয়াসহ নানা রকম কার্পজাতীয় মাছ ও মাছের পোনা। কর্মচারীরা নৌকায় করে পুকুরে খাবার ছিটিয়ে দিচ্ছেন। ফরিদপুর, খুলনা, ঢাকা, বরিশাল, বরগুনা, গোপালগঞ্জের মাছ চাষীরা পিকআপে করে পোনা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। কথা হয় নান্নুর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘আমার পুঁজি ছিল স্বপ্ন। আমি গ্রামের লোকদের সঙ্গে নিয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছি। যশোর জেলায় রেকর্ড পরিমাণ পোনা উৎপাদন করেছি। এ কারণে আমি জেলার শ্রেষ্ঠ মৎস্য চাষী হিসাবে ২০০৯ ও ২০১৪ সালে পুরস্কার পেয়েছি। বড় পুরস্কার হচ্ছে আমাকে অনুসরণ করে আমার সহযোগিতায় বেকার যুবকরা বাঁচার পথ খুঁজে পেয়েছে।’ তিনি আরও জানান, তার ১৫০ বিঘা আয়তনের খামারে ৩২টি পুকুর রয়েছে। এখানে বছরে তিন থেকে চার কোটি কার্প জাতীয় মাছের পোনা উৎপাদন করছেন তিনি। সেই পোনা দেশের বিভিন্ন মাছ চাষীর কাছে বিক্রি করছেন প্রায় তিন কোটি টাকায়। নান্নুর এই বিশাল পোনাযজ্ঞে গ্রামের তরুণ যুবকরাও যুক্ত হয়েছে। তার দেখাদেখি অনেকেই মাছ চাষে এগিয়ে এসে ভাগ্য বদল করেছে। মালিডাঙ্গা গ্রামের যুবক গৌতম বিশ্বাস বললেন, ‘নান্নু ভাই আমাদের আদর্শ। আমি ভবঘুরে ছিলাম। তার কাছ থেকে হাতে-কলমে মাছ চাষ শিখে ৩টি পুকুরে মাছ চাষ করে আমি বেকারত্ব দূর করেছি।’ পাশের গ্রাম হুগলাডাঙ্গার মাছচাষী আব্দুল হাই বললেন, ‘আমিও বেকার ছিলাম। মাছ নান্নু আমাকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এখন আমি একজন সফল মাছচাষী।’ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রমজান আলী বললেন, ‘নান্নুর মৎস্য খামারটি খুবই আধুনিক। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে খামারটি গড়ে তুলেছেন। তাঁর উৎপাদিত পোনার গুণগত মানও ভাল। আমরা তাকে সবসময় সহযোগিতা করি। মাছ চাষে তিনি অনেকেরই দৃষ্টান্ত হতে পারেন।’মিলন রহমান/এসএস/এমএস