মতামত

ঈদ কতটা আনন্দময়?

আসুন আমরা কয়েকটি দৃশ্যের কথা চিন্তা করি।

দৃশ্য ১: একটি শিশু চুপচাপ বসে আছে রাস্তার ধারে। ওর পরণে স্কুল ইউনিফর্ম নয়, ছেঁড়া ময়লা একটি হাফপ্যান্ট। সারা মাস রাস্তায় গাড়ির কাঁচ মুছে যেটুকু পেয়েছে তা দিয়ে ঈদের একটা কাপড় হবে কিনা সেই হিসাব কষছে ওর ছোট্ট মন। ওর সামনে রাস্তার সিগনালে যে গাড়িগুলো থেমে আছে কিছুক্ষণের জন্য সেগুলোর কাঁচ উঠানো। একটি গাড়ির ভিতরে হাসি মুখে বসে আছেন এক মা ও তার দুই মেয়ে। পাশে অনেকগুলো শপিংব্যাগ। আরো কয়েকটি গাড়ির ভিতরেও একই রকম শপিং ব্যাগের ছড়াছড়ি। ছেলেটি ভাবছে আর কতগুলো গাড়ির কাচ মুছলে ওর নিজের, ছোটবোনটার আর মায়ের জন্য ঈদের কাপড় হবে?

দৃশ্য ২: ইফতারির জন্য ডালবাটা শেষে করে ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে বের হলো সুফিয়া। আবার অন্যবাড়িতে যেতে হবে। এরই ফাঁকে একবার মুদির দোকানে ও জানতে চায় পোলাওর চালের কেজি কত। দাম শুনে মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। তার ছোট ছেলেমেয়েগুলো পোলাও খেতে ভালোবাসে। ঈদের দিন কি ওদের একটু পোলাও রান্না করে দেয়া যাবে? বেতনের টাকা চলে যায় ঘরভাড়া আর অন্যসব দরকারি কাজেই। ঈদের জন্য বাড়তি তেমন কিছু হাতে থাকবে না। যদি ম্যাডামরা কিছু দয়া করে দেন তবে হয়তো হতে পারে।

দৃশ্য ৩: রাঙামাটি। পাহাড় তো নয়, আকাশ ভেঙে পড়েছে এখানে। খাবারের জন্য চলছে হাহাকার। এখানে ঈদ নেই। শুধুই মৃত্যু, শুধুই ক্ষুধা। ‘রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।’ ঢাকার শপিং কমপ্লেক্সগুলোতে ভিড়। অনেক ব্র্যান্ড শপে ঢোকারও উপায় নেই ভিড়ের জন্য। দামি পোশাক বিক্রির জন্য ঢাকার কয়েকটি দোকান ও শপিংমল বিখ্যাত। সেখানে লাখটাকা দামের পোশাকও বিক্রি হচ্ছে। শুধু পোশাক নয়, জুতো, ফ্যাশন এক্সেসরিজও বিক্রি হচ্ছে এই শেষ সময়ে। বিউটিপার্লারগুলোতে ভিড়। সবাই চায় আরও সুন্দর হয়ে উঠতে। বাড়িতে বাড়িতে চলছে রান্নার আয়োজন আর মেন্যু ঠিক করার পালা। সাদামাটা গতানুগতিকভাবে রান্না নয়। ঈদের দিনে বিশেষ কিছু। পোলাও, মাংস বিরিয়ানি, কাবাব হলেই চলবে না। আরও আরও অনেক পদের অনেক দেশের খাবার চাই। আজকাল ভিনদেশী রেসিপিতে তৈরি দুয়েক পদ খাবার অতিথির সামনে টেবিলে না দিতে পারলে ঠিক প্রেস্টিজ থাকে না।

আর ঈদে যারা অন্য দেশে বেড়াতে ভালোবাসেন তারা তো চলে গেছেন বা যাচ্ছেন। বছরে এই তো আনন্দের সময়। খুশির ঈদ বলে কথা। কিন্তু খুশির ঈদ সত্যিই কতটা খুশি বয়ে এনেছে দেশের নিন্মবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জীবনে? হাওরের মানুষরা কেমন আছেন? কেমন আছেন রাঙামাটির মানুষ? কেমন আছেন দেশের অসংখ্য খেটে খাওয়া মানুষ? কেমন আছে মহানগরীর পথশিশুরা? অথচ বিত্তবানদের একটু সহমর্মিতা ওদের ঈদকেও আনন্দময় করে তুলতে পারে। নিজের ছেলেমেয়েদের পোশাক কেনার পাশাপাশি যদি একজন পথশিশুকেও একটি মাত্র পোশাক কিনে দেয় সামর্থবানরা তাহলে প্রতিটি পথশিশুর নতুন কাপড় পাওয়ার কথা। গৃহকর্মী যে নারীরা কাজ করছেন ঢাকার ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে তাদের প্রতি একটু সহমর্মিতা তার ও তার পরিবারের ঈদকে আনন্দময় করে তুলতে পারে। কত ভালো খাবার রান্না হয় বাড়িতে। তার থেকে ওর ছেলেমেয়েদের জন্য যদি কিছু দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তাদের ঈদটাও খুশির হয়। একথা ঠিক যে, অনেকেই দেন। সেটা ভালো। সকলেই যদি দেন তাহলে আরও ভালো হয়।

অনেকেই ঈদ করতে যাচ্ছেন গ্রামের বাড়িতে। পরিবার পরিজনের জন্য উপহারও নিয়ে যাচ্ছেন । গ্রামের দরিদ্রতম যে পরিবার তার জন্য সামান্য কিছু উপহারও যদি নিয়ে যান তাহলে তাদের ঈদ হয়ে উঠবে আনন্দময়। যাকাতের শাড়ি লুঙ্গির মতো গড়পরতা দানের পাশাপাশি সামান্য একটু বিশেষ উপহার। যেটা শুধু ওই দরিদ্রতম ‘চাচা মিয়া’ কিংবা ‘খালা’র জন্যই বিশেষভাবে নেওয়া হয়েছে। হয়তো একটা টিশার্ট, কানের দুল কিংবা আতরের শিশি। ‘ঢাকা থেকে আনা’ বলে যে উপহার তিনি মনে রাখবেন সারাজীবন। যে শিশুটির বাবা মা নেই তাকে একটু কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করা ‘কি রে কেমন আছিস?’ ঈদের সালামি বলে তার হাতে ক’টি টাকা দেওয়া। হয়তো এটাই ওর সারাজীবনের আনন্দময় স্মৃতি হয়ে থাকবে।

মনে পড়ে ছোটবেলায় পুরান ঢাকায় ঈদের কথা। চকবাজারে ঈদের মেলা বসতো। মাটির হাড়ি পাতিল, হাতি, ঘোড়া, পাখি আর বউপুতুল বিক্রি হতো। টিনের বাঁশি, ডুগডুগি আর টিনের বাজনা। পাঁচ টাকার খেলনা কিনেই মন ভরে যেত খুশিতে। কাঠি আইসক্রিম, নাগরদোলা আর মুড়কি ছিল মেলার বড় আকর্ষণ। এই প্রজন্মের শিশুরা অনেক দামি খেলনা পেলেও অতটা খুশি হয় না। অল্পে সন্তুষ্টির বিষয়টা আমাদের মধ্য থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। শিশুকে ঈদে পোশাক, খেলনা অনেক কিছুই হয়তো দিচ্ছেন। তবে ওর জন্য সবচেয়ে বড় উপহার হবে যদি ব্যস্ত বাবা-মায়েরা তাদের একটু ‘কোয়ালিটি টাইম’ উপহার দেন। টিভিতে খেলা কিংবা সিরিয়াল দেখতে দেখতে শিশুর সাথে কথা বলার মতো ‘টাইম দেয়া’ নয়। তাদের নিয়ে গল্প করা, তাদের নিয়ে প্রকৃতির কাছে ঘুরতে যাওয়া, তাদের মনের ঘরে উঁকি দিয়ে আনন্দ-বেদনার খোঁজ নেওয়া। আসুন না এই ঈদটিকে আমরা আনন্দময় করে তোলার চেষ্টা করি আপন-পর, আত্মীয়-অনাত্মীয়, ধনী-গরীব, সবার জন্য।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/জেআইএম