মতামত

নিরঞ্জনরাই আগামীর বাংলাদেশ

আহমেদ সুমন :জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাস। ভরদুপুর। একটি ছেলে রিকশা চালাচ্ছেন। বয়স ষোলো কি সতেরো। পরনে জিন্সের প্যান্ট, গায়ে মোটামুটি দামের সুতি চেক শার্ট। ছেলেটির নাম নিরঞ্জন রায়। রিকশায় উঠে কথা হয় নিরঞ্জনের সঙ্গে। নিরঞ্জন প্রথমে কী এক জরুরি কাজের তাড়া আছে জানিয়ে রিকশায় কোনো যাত্রী উঠাতে চাননি। আমাকেও উঠাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। আমি গন্তব্যের দিকে হাঁটতে শুরু করি। দু’এক মিনিট হাঁটার পর দেখি নিরঞ্জন ফিরে এসেছে আমার কাছে। রিকশায় উঠতে বলে। আমি নিরঞ্জনের প্রতি কিঞ্চিত বিরক্ত ভাব নিয়ে রিকশায় উঠি বটে তবে মুহুর্তের মধ্যেই বিরক্তি ভাব কেটে যায়।নিরঞ্জনের কথা বলার ঢঙে তাকে শিক্ষিত মনে হয়। জিজ্ঞেস করে জানতে পারি নিরঞ্জন এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। শুনে আমি কথা এগিয়ে নিই। এসএসসি পরীক্ষা দেয়া এক কিশোর নিরঞ্জনের বাস্তব চিন্তা এবং সমাজ সংস্কৃতি সম্পর্কে তার ধারণায় মুগ্ধ হই। নিরঞ্জন জানান, তার বাড়ি পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার মালুয়াপাড়া গ্রামে। স্থানীয় মানিক পীর হাইস্কুল থেকে সে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। গত ২ এপ্রিল এসএসসি ব্যবহারিক পরীক্ষা দিয়েই সে জাহাঙ্গীরনগরের উদ্দেশে বাড়ি ছাড়েন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে ইসলামনগর গ্রামে নিরঞ্জনের বড় ভাই ভাড়া বাড়িতে বসবাস করেন। তিনি সাভার ইপিজেড-এ চাকরি করেন। বড় ভাইয়ের সূত্রে নিরঞ্জন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই সপ্তাহের জন্য রিকশা চালাতে এসেছেন। কেন? শোনা যাক নিরঞ্জনের মুখ থেকেই। ‘আমরা দুই ভাই এক বোন। বড় ভাই সুজন রায় অর্থাভাবে এইচএসসি পাশের পর আর লেখাপড়া করতে পারেননি। ছাত্র হিসেবেও সে তেমন ভালো ছিলেন না। এ কারণে এইচএসসি পাশ করেই সে চাকরিতে ঢুকে গেছে। বোন জয়ন্তী রায় এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। গত ২ এপ্রিল এসএসসির ব্যবহারিক পরীক্ষা দিয়েই বড় ভাইয়ের কাছে চলে আসি। আমার চার হাজার টাকা দরকার। পলিটেকনিক কলেজে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হতে চাই। ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য কোচিং করা দরকার। কোচিং ফি চার হাজার টাকা। বাবা বিদ্যা মোহন রায় একজন কৃষক। কৃষি কাজে বাবাকে সাহায্য করার কারণে কৃষি কাজ অনেকটা জানা আছে। অন্য কোনো কাজ শিখিনি। দ্রুত চার হাজার টাকা আয়ের জন্য রিকশাকে বেছে নিয়েছি। এক দিনেই রিকশা চালানো শিখেছি। দ্বিতীয় দিন থেকে যাত্রী উঠানোর জন্য রিকশা নিয়ে বের হয়েছি। দুই সপ্তাহে আমার কাঙ্ক্ষিত চার হাজার টাকা আয় হয়ে গেছে। ১৭ এপ্রিল শুক্রবারই বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। ১৯ এপ্রিল থেকে কোচিংয়ে ক্লাস শুরু করবো।’রিকশচালকদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ভেবে রিকশা চালাতে খারাপ লাগেনি? এমন প্রশ্নের জবাবে নিরঞ্জন কাজের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে তার ভিন্নমত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সমাজে যেকোনো বিষয়ে সব মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন নয়। সমাজে যোগ্যতা এবং প্রাপ্য অনুযায়ী যে যার কাজ করে। আসলে কোনো কাজই খারাপ না, নিজেকে বুঝা এবং সৎ থাকা প্রয়োজন। আমি পেশাদার রিকশা চালক না। দ্রুত টাকা আয় করার জন্য রিকশাকে বেছে নিয়েছি মাত্র। রিকশা চালানো আমার পেশা হবে না। আমি এখানে অন্যের ভাবনার বিষয় আমলে নিলে আমার চার হাজার টাকা যোগাড় হতো না। অন্যের ভাবনা আমার জীবনের লক্ষ্য পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেটা হতে দেয়া ঠিক না। যেটা ঠিক না, সেটা করলে জীবন এগোবে কীভাবে?আমি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছে রাখি। আশা করি, তখন মাসে ভালো একটা আয় করতে পারবো। বাবা বিদ্যা মোহন রায় আর মা বিমলা রাণী আমাদের ভাই-বোনদের সব সময় বলে থাকেন, কোনো কাজকে যেন অসম্মানের চোখে না দেখি। লেখাপড়া শিখে যেনো নিজ পায়ে দাঁড়াতে পারি।’ জরুরি কাজের বিষয় জানতে চাইলে নিরঞ্জন বলেন, উপ-বৃত্তির টাকা তুলতে বাবাকে স্কুলে যেতে ফোন করার একটা তাগিদ ছিলো। সেটা একটু পরে করলেও হবে ভেবে ফিরে এসেছি। ফোন একটা সঙ্গে ছিলো। সেটা চুরি হয়ে গেছে। আসলে যার যেটা কাজ, সেটাই তার কাছে জরুরি। চোরের তো এ কথা ভাববার বিষয় না যে, আমার ফোনটা আমার জন্য কতো জরুরি। এখন অবশ্য দোকান থেকে মাত্র পাচ টাকা খরচ করলেই প্রয়োজনীয় সব কথা বলা যায়। এসএসসির ভালো ফলাফলে নিরঞ্জন আশাবাদী। স্কুলের ২৬ জন বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর মধ্যে টেস্টে সে তৃতীয় হয়েছে। দশম শ্রেণিতেও তার রোল নম্বর ছিলো তিন। এসএসসি পরীক্ষাও ভালো দিয়েছে।আমাদের সমাজে হাজারো শিক্ষার্থী লেখাপড়ার জন্য মাসে হাজার হাজার টাকা পরিবার থেকে নেয় বা পরিবার থেকে তাকে দেয়া হয়। নিরঞ্জন কোচিং ফি বাবদ চার হাজার টাকা তার বাবা কিংবা বড় ভাইয়ের কাছে চাইতে পারতেন। সেটা সে না করে নিজেই আয় করেছেন। এ প্রসঙ্গে তার অভিমতটি অনেক ছাত্র-ছাত্রীর জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। ‘সুযোগ থাকলেই কারো কাছে কিছু চাওয়া ঠিক না। এমনি কি বাবার কাছেও না।’ চাহিদা স্ব-উদ্যোগে পূরণ করতে পারলে তাতে অনেক আনন্দ থাকে। এ আনন্দের স্বাদ বুঝতে পারলে পরিশ্রমকে কখনো ভয় লাগে না। নিরঞ্জন শুনেছে যে, উন্নত দেশে যোগ্যতা অনুযায়ী সবাই কাজ করে নিজে আয় করে। সেসব সমাজে কেহ বসে খায় না। ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা ছুটিকালীন সময়ে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। এভাবে কর্ম দিয়েই তারা উন্নত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নিরঞ্জন আরো শুনেছে বসে খেলে রাজার ভাণ্ডারও খালি হয়ে যায়। তাই সে প্রয়োজনীয় চার হাজার টাকা নিজ থেকে আয় করতে চেয়েছে। তার পরিবার সদস্যরা তার এই সিদ্ধান্তে খুশি।      এবার চাকরির বাজারের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। সেখানে নিরঞ্জনদের জন্য কী অবস্থা বিরাজ করছে? বাংলাদেশে প্রায় সবার মধ্যেই সাধারণ ধারণা যে, চাকরি মানেই সোনার হরিণ। এ সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে ছুটতে অনেকের জীবন নাকাল। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। বাংলাদেশে কাজের বাজার দিনে দিনে বড় হচ্ছে। দেশের কর্মক্ষেত্র নিয়ে সরকারি জরিপ এবং বিশ্বব্যাংক ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন বলছে, চলতি অর্থবছরে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ১৯ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। সামনের বছরগুলোতে এই বৃদ্ধির হার আরো আশাব্যঞ্জক হবে।পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ২০১১-১৫ এ পাঁচ বছরে মোট এক  কোটি চার লাখ লোকের নতুন কর্মসংস্থানের লক্ষ্য রয়েছে। আর বিশ্বব্যাংক বলছে, এখন প্রতিবছর নতুন করে ১৩ লাখ মানুষ বাংলাদেশর শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০১২ সালের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হওয়াতেই দেশের কাজের বাজার বড় হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১০-১১ থেকে ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশের ভেতরে নতুন সাড়ে ৪৭ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।২০১১-২০১৫ এ পাঁচ বছরে দেশ ও দেশের বাইরে মোট এক কোটি চার লাখ লোকের কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। সেই হিসেবে, এ অর্থবছরে প্রায় ১৭ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। একই সময়ে দুই লাখ লোক কাজের জন্য বিদেশে যাবেন। সব মিলিয়ে নতুন করে প্রায় ১৯ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। সরকার চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। কাজের এই বড় বাজার নিরঞ্জনদের ডাকছে। এখন প্রয়োজন শুধু নিজেদেরকে প্রস্তুত করে তোলা। নিরঞ্জন সেই কাজে মনোযোগী হয়েছে। নিরঞ্জনের আগ্রহ  ইলেকট্রনিক্সে। সেবামূলক এ খাতে চাকরির সুযোগ উত্তরোত্তর বাড়ছে। দেশে এখন ছয়টি মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের তথ্য অনুসারে, দেশে মোবাইল গ্রাহকের ১১ কোটি ৬৫ লাখ। সক্রিয় এ বিপুল গ্রাহককে সেবা দেওয়ার জন্য প্রতিটি মোবাইল অপারেটর নানা পর্যায়ে লোক নিয়োগ দিয়ে আসছেন। মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এমটব-এর তথ্যানুযায়ী ছয়টি মোবাইল কোম্পানিতে স্থায়ী পদে আছেন ১৩ হাজার কর্মী। তবে এ খাতে নানা স্তরে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৬ লাখ মানুষের। ফোনে টাকা ভরা (রিচার্জ) পাশাপাশি এখন মোবাইল ব্যাংকিং সেবাও  দেওয়া হচ্ছে সেখানে। এ ছাড়াও মোবাইল ফোন মেরামত, বিভিন্ন উপকরণ বিক্রি করেও অনেকে স্বাবলম্বী হয়েছেন। পাশাপাশি কম্পিউটারনির্ভর বিভিন্ন সেবার প্রচুর দোকান ও সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সারাদেশে। এ সেবা খাতে নিরঞ্জনদের মতো যারা দক্ষ হয়ে উঠবেন, তাদের ভালো করার সম্ভাবনা অনেক বেশি।পরিশেষে বলা যায় যে, নিরঞ্জনের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে আসা গল্প নতুন প্রজন্ম সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা মেলে। নিরঞ্জন এ প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি। নিরঞ্জনের জীবনবোধ, কাজের প্রতি সম্মান ও স্বনির্ভর হওয়ার যে দৃঢ় মনোভাব, তা আমাদেরকে আলোড়িত করে। আমরা বিশ্বাস করি, নিরঞ্জনদের মাধ্যমে সমাজ বদলে যাবে। তারাই বিনির্মাণ করবে আগামীর বাংলাদেশ।লেখক : গবেষক ও বিশ্লেষকasumanarticle@gmail.comএইচআর/বিএ/এমএস/এমএস