বাংলাদেশের প্রস্তাবনায় সাউথ এশিয়ান রিজিওন্যাল কোঅপারেশন (সার্ক) গঠিত হয়েছিলো। নেপালের কাঠমাণ্ডুতে এর সচিবালয় স্থাপিত হলেও সার্ক বিশ্ববিদ্যালয়সহ এই আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার অধিকাংশ অঙ্গ-প্রতিষ্ঠানই ভারতে স্থাপিত হয়েছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত দেশ হিসেবে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করা হয় সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র (SMRC)। এই কেন্দ্র শুধু বাংলাদেশে নয়, সার্ক অঞ্চলের দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ে ঝুঁকি সমূহ চিহ্নিতকরণসহ গবেষণা করে থাকে। অথচ এই গবেষণা কেন্দ্রটি ডিসেম্বর ২০১৫-এর মধ্যে ঢাকা থেকে উঠিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সার্ক সচিবালয়। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সার্কের প্রস্তাবক রাষ্ট্র হিসেবে সার্ক কৃষি কেন্দ্র ও স্পার্সোর ২টি ক্ষুদ্র উইং ছাড়া বাংলাদেশে সার্কের বড় ধরনের আর কোনো প্রতিষ্ঠান থাকছে না। সার্কের মূল আদর্শ আঞ্চলিক সহযোগিতা চুক্তি নীতির এটি পরিপন্থী সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত রহিত না হলে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঢাকার আগারগাঁওয়ে ১.২২ একর নিজস্ব ভূমিতে অত্যাধুনিক অফিস উপকরণে সুসজ্জিত কেন্দ্রটির নিরবচ্ছিন্ন গবেষণালব্ধ প্রকাশনা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উচ্চতর শিক্ষায়-গবেষণায় স্বীকৃত। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, ঘূর্ণিঝড়, বজ্রঝড়, শিলাবৃষ্টি, টর্নেডো, aviation hazards, monsoon, কৃষি আবহাওয়া প্রভৃতি বিষয়ে কেন্দ্রটি ইতিমধ্যে ৬৫ টি Scientific reports এবং Proceedings প্রকাশ করেছে। এছাড়াও অত্যন্ত উচ্চমানসম্পন্ন ৭৭ টি গবেষণা প্রবন্ধ বিভিন্ন খ্যাতনামা আন্তর্জাতিক জার্নালে (USA, UK, EU, Canada, Japan, India etc.) প্রকাশিত হয়েছে। এখানে আছে সার্ক অঞ্চলের অভিজ্ঞ গবেষক, আবহাওয়া বিজ্ঞানী, দক্ষ কর্মকর্তা-কর্মচারি ও গবেষণার উন্নত উপকরণ- আধুনিক কম্পিউটার সার্ভার, সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার ইত্যাদি। স্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত গবেষকগণ আবহাওয়া-জলবায়ু বিজ্ঞানে সুদক্ষ, আন্তর্জাতিকভাবে উচ্চতর ডিগ্রি ((PhD, M Phil, Diploma), প্রশিক্ষণ ও পুরস্কারপ্রাপ্ত। এ কেন্দ্রের সাথে বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠানের (Nagoya, Kyoto University, RIMES etc.) সমঝোতা চুক্তি আছে।কেন্দ্রটির সম্পদ ও উপকরণ ব্যবহার করে কেন্দ্রের গবেষকদের তত্ত্বাবধানে ৬০ জন দেশি/বিদেশি গবেষক, সরকারি/বেসরকারি কর্মকর্তা PhD, M Phil, MS ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং বর্তমানে গবেষণারত আছেন। এ কেন্দ্রের মাধ্যমে সার্ক অঞ্চলের ১০০০ জন আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষককে উচ্চতর প্রশিক্ষণ-কর্মশালার মাধ্যমে সার্ক দেশের জনগণের সক্ষমতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। এ কেন্দ্রের SAARC STORM, Monsoon Initiative প্রোগ্রাম এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সহ সার্ক দেশগুলোতে রাডার, স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশন (AWS), GPS sonde ইত্যাদি দেয়া হচ্ছে। এগুলো চলমান প্রক্রিয়া। কেন্দ্রটি বাংলাদেশের তথা সার্ক অঞ্চলের প্রথম ও একমাত্র আবহাওয়া-জলবায়ু বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র। এটি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি করে আসছে। কেন্দ্রটিতে গাণিতিক মডেলে থ্রি ও ফোর ডাইমেনশনাল ডাটা অ্যাসিমিলেসন প্রযুক্তির মাধ্যমে রাডার, স্যাটেলাইট, GTS, AWS সহ অন্যান্য ডাটা ব্যবহার করা হয়। এগুলো আবহাওয়া-জলবায়ু বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। এ ধরনের নতুনতর প্রযুক্তি NASA-USA, ECMWF-EU, UK Met Office-UK, IITM-India, NCMRWF-India, KIAPS-Korea এসব প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেন। কেন্দ্রটি আধুনিক গবেষণার মাধ্যমে জনজীবন বাঁচাতে, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবেলায় অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলছে। সুদীর্ঘ ২০ বছর ধরে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দেশি/ বিদেশি গবেষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠা এ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া অসম্ভব। ফলে দেশ হারাবে কেন্দ্রটির সুদক্ষ গবেষক ও গবেষণার ধারাবাহিকতা। সারা বিশ্বে আবহাওয়া-জলবায়ু বিজ্ঞান গবেষণা ও গবেষকগণের গুরুত্ব অপরিসীম। অথচ বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরে আলাদা করে কোনো আবহাওয়া-জলবায়ু বিজ্ঞান গবেষণার ব্যবস্থা নেই। এমনকি বাংলাদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবহাওয়া-জলবায়ু বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক/স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পড়ানোর ডিপার্টমেন্ট নেই। এ বিষয়ে উচ্চতর গবেষণারও সুযোগ নেই। কেন্দ্রটির গবেষণা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সচল রেখে জনশক্তিকে কাজে লাগালে বাংলাদেশের পাশাপাশি সার্ক দেশসমূহও উপকৃত হবে। দেশ ও জনগণের কল্যাণে গবেষণা কেন্দ্রটি চালু রেখে এর সুদক্ষ গবেষক ও জনশক্তি কাজে লাগানো জরুরি।সার্কের প্রভাবশালী রাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফর করছেন। এই সফরকালে তিনি বাংলাদেশর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক সহযোগিতা বিষয়ে আলোচনা করবেন এবং বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষর হবে উভয় দেশের মধ্যে। এই পরিস্থিতে দেশের পরিবেশবিদ, আবহাওয়া বিজ্ঞানী ও সচেতন মহল প্রত্যাশা করছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি নিয়ে সার্কের প্রভাবশালী নেতা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনা করবেন এবং সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রটি যাতে বাংলাদেশেই থাকে এবং সার্ক প্রোগ্রাম কমিটির ৪৬ তম সভায় গৃহীত বাংলাদেশ, ভারত, মালদ্বীপ ও ভূটানের ৪টি আবহাওয়া কেন্দ্রকে একভূীত করে যে “ সার্ক এনভায়রনমেন্ট এন্ড রিক্স ম্যানেজমেন্ট সেন্টার” (এসইডিএমসি) গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা যেনো বাংলাদেশেই প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। দেশবাসী এখন এটাই প্রত্যাশা করছে। এইচআর/এমএস