‘উঠ...ঠো ...রোজদারও...আল্লাহ কা... পেয়ারে বান্দে, রাত তিন বাজগায়া, সেহরি খালো (রোজাদাররা উঠো, আল্লাহ’র প্রিয় বান্দারা, রাত তিনটা বেজে গেছে, সেহরি খেয়ে নাও)।’ মাত্র কয়েকবছর আগেও পুরান ঢাকায় মধ্যরাতে কোরাস গাণ গেয়ে রোজাদারদের সেহরি খেতে ঘুম থেকে ডেকে তোলার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল।ওই সময় একদল যুবক সেহরির ঘণ্টাখানেক আগে থেকেই বিভিন্ন পাড়ামহল্লার অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতো। তারা কোরাস গাণ গেয়ে সেহরি খেতে ঘুম থেকে উঠতে আহ্বান জানাতো। তাদের ডাক শুনে পরিবারের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘুম থেকে উঠে তাদের একনজর দেখতে বাইরে তাকাতো। কিন্তু তারা খুব দ্রুত হেটে প্রস্থান করতো।ওরা কোথায় জিজ্ঞেস করলে বাবা মায়েরা বলতেন, ‘আরে ওরা তো মানুষ নয়, জ্বিন। রোজাদারদের সেহরি খেতে ডেকে তুলতে আল্লাহ ওদের পাঠিয়েছেন। তাই ওদের দেখা পাওয়া যায়না, হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।’কোরাস পার্টির সদস্যরা ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় অর্থাৎ চাঁদরাতে প্রতিটি বাসার কলিং বেল বাজাতো। ছেলেমেয়েরা দরজা খুলে অপরিচিত লোকদের দেখে ভয়ে ভয়ে পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে তারা হেসে বলতো ‘মাগো আমরা ঘুম ভাঙ্গানি পার্টি। সারামাস তোমাদের সেহরি খেতে ঘুম ভাঙ্গিয়েছি। যাও বাবা মায়ের কাছ থেকে আমাদের সালামি নিয়ে আস।’সেই সব দিনগুলো এখন শুধুই অতীত। পুরান ঢাকায় এখন আর ঘুম ভাঙ্গানো সেই পার্টিকে কোরাস গান গাইতে শোনা যায়না। ডিজিটাল প্রযুক্তির এ যুগে এখন মোবাইলের অটো অ্যালার্মে তাদের ঘুম ভাঙ্গে। বড় বড় অ্যাপার্টমেন্টের সিকিউরিটি গার্ডরা ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে ইন্টারকমে সেহরি খাওয়ার সময় হলে ডেকে দেন। কিন্তু পুরান ঢাকার বাসিন্দারা আজও সেই কোরাস গানের সেহরি কাফেলার শূন্যতা অনুভব করেন।পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের বাসিন্দা সিরাজ মিয়া জানান, আগে রমজান মাস এলেই প্রতিরাতে কোরাস গানে ঘুম ভাঙ্গতো। ঘণ্টা খানেক আগে থেকেই তারা ঘুরে ঘুরে সেহরি খাওয়ার আহবান জানাতো। কিন্তু এখন সব কিছু কেমন যেন পানসে হয়ে গেছে। সেই কোরাস গানের পার্টিও নেই। মসজিদ থেকেও আর সময় জানানো হয়না। ডিজিটাল সুবিধা ভোগ করে আমরা কেমন যেন অ্যানালগ হয়ে গেছি।আজিমপুরের বাসিন্দা শাহনাজ বেগম জানান, ছোট বেলায় বাবা মা বয়স কম বলে রোজা রাখতে দিতেননা। কিন্তু কোরাস পার্টির হাক ডাক শুনে ঠিকই ঘুম ভেঙ্গে খাবার টেবিলে যোগ দিতাম। গত বেশ কয়েক বছর কোরাস পার্টির হাকডাক শুনতে পাইনা।লালবাগের খাজে দেওয়ানের ক্ষুদে ব্যবসায়ী সালাম মিয়া জানান, ‘ছোট থেকে এই মহল্লায় বড় হয়েছি। আগে সেহরি খাওয়ার সময় গোটা মহল্লার মানুষ জেগে উঠতো, ঘণ্টাখানেক দোকানে আড্ডা মেরে সেহরি খেয়ে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাতে যেত। এখন সবাই চুপচাপ খায়দায় আর ঘুমায়।’তিনি বলেন, ‘শুধু কোরাস পার্টিই নয় আগে পুরান ঢাকার সবগুলো মসজিদ থেকে মাইকে সেহরির আর কত মিনিট বাকি আছে তা জানিয়ে বারবার ঘোষণা দেয়া হতো। ১৫মিনিট আধা ঘণ্টার বিরতিতে সাইরেন বাজানো হতো।’কিন্তু গত কয়েকবছর যাবত কোরাস পার্টির ঘুম ভাঙ্গানি গানও নেই, মসজিদ থেকেও আর কোন ঘোষণা আসেনা বলেও জানান তিনি।এমইউ/এসএইচএস/আরআই