মতামত

দেখতে খারাপ হলেও জিনিস কিন্তু ভালো!

বাঙালির উদ্ভাবনী মেধায় আমি বরাবরই মুগ্ধ। বিশেষ করে সেই মেধা যখন তারা স্যাটায়ারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। শুধু আফসোস বাংলাদেশে ভালো মানের কোনো স্যাটায়ার পত্রিকা নেই। তাই বলে কি ফুলে ফেঁপে ওঠা মেধা আটকে রাখা যায়? ও ঠিকই বেরোনোর পথ বের করে নেয়। এই যেমন ফেসবুকে একজন লিখেছেন, `নদীর জল (গম) ঘোলাও (ভাঙ্গা ও নিন্মমানের) ভালো, জাতের মেয়ে কালোও (পোকাও) ভালো।` সত্যি, এমন সুখাদ্য (!) গমের এমন উপাদেয় মূল্যায়ণ বাঙালি ছাড়া আর কে করবে!`গমরুল` শব্দটি এখন আমাদের প্রাত্যহিক কথাবার্তার অভিধানে ভালোভাবেই ঢুকে পড়েছে। গমরুল শব্দটির উৎপত্তি কোথা থেকে, কিভাবে হলো- তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতে পারে। তা বাংলাদেশে গবেষণা করার লোকের অভাব নেই। আপাতত রসিক বাঙালি এমনভাবে `গমরুল` শব্দটি ব্যবহার করছেন, যেখানে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন ব্রাজিলের নামটি জড়িয়ে যাচ্ছে। কেনরে বাবা? ব্রাজিল ভালো ফুটবল খেলে বলে তোদের এত মন খারাপ কেন? না হয় ওদের ফুটবলারদের চেহারা রাজপুত্র টাইপের নয়। কিন্তু ফুটবলতো ওরা খেলে শিল্পীর মতোই। তা এমন দেশের আরো দু`চারটা জিনিসতো এমনই হবে। যেমন ফুটবলারদের মতোই দেখতে খারাপ ওদের গম। কিন্তু গুণে মানে ওটা সবার সেরা।  বিষয়টা আর কেউ না বুঝলেও কামরুল সাহেব কিন্তু ঠিকই বুঝেছেন। বুঝেছেন বলেইতো তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বলতে পেরেছেন, দেখতে খারাপ হলেও মাল ভালো। মন্ত্রী সাহেব অবশ্য এই ভাষায় বলেননি। দুর্মুখরা এভাবে বলছে। মন্ত্রী সংসদে যা বলেছেন তা হলো, ব্রাজিল থেকে আমদানি করা গম দেখতে খারাপ হলেও গুণগত মান নষ্ট হয়নি।মন্ত্রী এমনটা বলতেই পারেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, এই মান নষ্ট না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে উনার এতদিন সময় লাগলো কেন? উনি কি পরীক্ষাগারে গবেষণার প্রতিবেদনটি হাতে পেয়ে গেছেন? নাকি নিজে ওই গম খেয়ে কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখেছেন স্বাস্থ্যগত কোনো সমস্যা হয় কিনা? প্রথমটি হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ আদালতের নির্দেশে খাদ্য অধিদপ্তর গম পরীক্ষার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তা নিয়ে আদালত এখনো কোনো আদেশ দেয়নি। কাজেই ওই প্রতিবেদনে কি আছে সেটা খাদ্যমন্ত্রীর জানার সুযোগ নেই। তাহলে কি অনেকের দাবি অনুযায়ী খাদ্যমন্ত্রী নিজেই বিতর্কিত এই গম খেয়ে তারপর জানালেন মান নষ্ট হয়নি? তবেতো মন্ত্রীকে সাধু সাধু বলতেই হয়। কিন্তু মন্ত্রীতো তা বলেননি!তবে কি ওই গম পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত কেউ মন্ত্রীকে ফলাফল জানিয়ে দিয়েছেন? সেটা করার আইনগত এখতিয়ার কি তার আছে? আমার মনে হয় সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী বেআইনী পন্থায় কোনো তথ্য নেবেন না।খাদ্য অধিদপ্তরের কথাই যখন উঠলো তখন মনে পড়লো আরেকটি কথা। সংসদে জাতীয় পার্টির সদস্য পীর ফজলুর রহমানের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘গম আমদানি করে খাদ্য অধিদপ্তর। এখানে মন্ত্রণালয়ের কিছুই করার নেই। এ সংক্রান্ত বিলও মন্ত্রণালয়ে আসে না।` ব্যস, ল্যাঠা চুকে গেলো। মন্ত্রীর কোনো দায়িত্ব নেই। সব দোষ এখন অধিদপ্তরের। হবে নাই বা কেন? অধিদপ্তর যে মন্ত্রণালয়কে কোনো বিলই পাঠায় না। তাহলে বেচারা মন্ত্রীর কি দোষ! হুজুগে বাঙালি কিছু না জেনে না বুঝে এমন নির্দোষ গোবেচারা মন্ত্রীর পদত্যাগ চাইছে। শুধু শুধু একজন মাননীয়কে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে বেচান করার কোনো মানে আছে?এই দেশের গণমাধ্যমগুলোও হয়েছে একেকটা। খালি ভিত্তিহীন খবর দেবে। এইতো সেদিনও এই সংসদে দাঁড়িয়েই কৃষিমন্ত্রী কত ক্ষোভ জানালেন। তারপরও না এই সাংবাদিকদের ভিত্তিহীন খবর দিতেই হবে। তা মন্ত্রী সাহেব দিন না একটা মামলা ঠুকে। আপনার এক সহকর্মিতো আছেনই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করতে সিদ্ধহস্ত। আপনি নিজেওতো উকিল মানুষ। মামলা করে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন যাতে ভিত্তিহীন খবর প্রকাশে কেউ সাহস না পায়। তেমনটি হলে কিন্তু সাংবাদিকতারই উন্নয়ন হবে।মন্ত্রী মহাশয় নিজে কতখানি ভিত্তিহীন কথা বলতে পারেন তার প্রমাণ কিন্তু ভূরি ভূরি আছে। গেলো ছয় বছর বিভিন্ন স্থানে উনি যেসব উক্তি দিয়েছেন সেগুলো পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে। কষ্ট করে আপাতত পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করার দরকার নাই। আজকের এবং ক`দিন আগের যোগসূত্র দিয়ে একটি ঘটনার বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে বিষয়টি। করছেন? মন্ত্রী সংসদেই বলেছেন, ‘সাংসদরা এলাকায় গম ঢুকতে দেননি বলে যে সংবাদ পরিবেশন হয়েছে, তাও ভিত্তিহীন। আমি সাংসদের সঙ্গে কথা বলেছি। উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাংসদের বিরোধের জের থেকে এ ঘটনা ঘটেছে। গম পচা বলে এটি ঘটেনি।` আসলে এই ঘটনা গেলো ৪ জুলাইয়ের। ওইদিন প্রায় সবগুলো টেলিভিশনে সংবাদটি প্রচার করা হয়। প্রকাশ করা হয় দৈনিক পত্রিকাগুলোর অনলাইন সংস্করণে। কি ঘটেছিলো ওইদিন? খুলনা বিভাগীয় খাদ্য গুদাম থেকে ১৫ ট্রাক গম নেয়া হয়েছিলো কুষ্টিয়ার কুমারখালী খাদ্য গুদামে। সেখানে গম ঢোকানোর কাজও শুরু হয়েছিলো। কিন্তু বাধ সাধেন আওয়ামী লীগেরই স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুর রউফ। কুষ্টিয়া-৪ আসনের এই সাংসদ সাংবাদিকদের স্পষ্টই জানান, `এই গমগুলো নিম্নমানের গম। ১৬ ট্রাক (প্রকৃতপক্ষে ১৫ ট্রাক) গম এখানে এসছে। আমি সমস্ত গম এখান থেকে ফেরত যেতে বলেছি এবং আটকে দিয়েছি। কোনো গম এখানে আনলোড হবে না। এই গমটা নিম্নমানের গম।`আব্দুর রউফের এই বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ টেলিভিশনগুলোর কাছে আছে। এখানে তিনি কোথাও উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে নিজের বিরোধের কথা উল্লেখ করেননি। তাহলে এই বিরোধের বিষয়টি খাদ্যমন্ত্রী কোথা থেকে আনলেন? সত্যিই কি তার কাছে এমন অভিযোগ করেছেন সংসদ সদস্য? ভিত্তিহীন কথা কে বলছে? সংসদ সদস্য নাকি মাননীয় মন্ত্রী? নাকি ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন করছে গণমাধ্যমগুলো? পুলিশ-বিজিবি এই গম নিচ্ছে না বলে যে প্রচারণা, তাও সত্য নয়। আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা এ ধরনের কোনো অভিযোগ পায়নি।’খাদ্যমন্ত্রী সংসদকে আরো জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসনগুলোর মাধ্যমে গমের নমুনা আনিয়ে খাদ্য অধিদপ্তর এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করানো হয়েছে। তারাই নাকি বলেছে গমগুলোর মান নষ্ট হয়নি। মাননীয় মন্ত্রী, আপনি তাহলে সেই পরীক্ষার প্রতিবেদন কেন সরবরাহ করছেন না? বিশেষ করে ওইসব গণমাধ্যমে- যারা আপনার ভাষায় ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশ করেছে। নিজের, সেইসঙ্গে মন্ত্রণালয় এবং খাদ্য অধিদপ্তরের ভাবমূর্তির স্বার্থে এই প্রতিবেদনতো আপনার প্রকাশ করা উচিৎ। এটি প্রকাশ করা হলে জনগণও যে হাফ ছেড়ে বাঁচে। তারাও যে নিশ্চিন্তে ওই ব্রাজিলিয় গম খেতে পারে। কোনো বিতর্কই থাকে না। চুকেবুকে যায় সব কিছু। নাকি বিতর্ক চাঙ্গা রাখতে পারলে অন্য কোনো লাভ আছে? নাকি সাংসদ আব্দুর রউফের প্রকাশ্য বক্তব্য আপনার কাছে তার বক্তব্যের মতোই কোনো হেরফের আছে এখানেও?পরিশেষে মনে পড়ে গেলো আরেকটা ঘটনা। একবার মোটাসোটা এক দারোগাকে দেখেছিলাম প্রচণ্ড রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে কর্তব্য পালন করছেন। সেকি হাঁসফাঁস অবস্থা তার। নিচুস্বরে একজন মন্তব্য করেছিলো, ` ঘুষ খাইয়া খাইয়া মোটা হইছো। এইবার বোঝো রইদের মইধ্যে ডিউটি করতে কেমন লাগে?` আরেকজনের মুচকি হাসির জবাব, `আরে ভাই, মোটা হলেই তো আর ঘুষখোর দারোগা হয় না!`লেখক : বার্তা সম্পাদক, এসএটিভিshahariar@journalist.comএইচআর/পিআর