পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশের নিজস্ব মাতৃভাষা আছে। কোনো দেশের জনগণ জন্মের পর থেকে মায়ের মুখে শুনে যে ভাষায় কথা বলতে শেখে, তা ওই দেশের মাতৃভাষা। অর্থাৎ মায়ের মুখে শুনে শিশু যে ভাষায় কথা বলতে শেখে তাকেই মাতৃভাষা বলে। তবে প্রত্যেক দেশেরই একটি নির্দিষ্ট মাতৃভাষা থাকে যা রাষ্ট্র কর্তৃক সংবিধান স্বীকৃত। পৃথিবীর সব দেশের মতো বাংলাদেশেরও একটি নির্দিষ্ট মাতৃভাষা আছে।
Advertisement
আমরা জানি, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। কিন্তু আমাদের মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত হতে অনেক রক্ত ঝরাতে হয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে কতিপয় ছাত্রনেতাসহ বীর বাঙালির জীবনের বিনিময়ে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাকে এ দেশের মাতৃভাষা হিসেবে তৎকালীন সরকার স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঊনিশ বছর আগে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষি জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
আজ ৬৩ বছরে এসে মনে হয়, আমরা আমাদের কথা ও কাজে প্রমাণ করতে পারছি না। বিশ্বের অন্য কোনো দেশ তাদের মাতৃভাষার জন্য এতটুকু আন্দোলন করেছে কিনা তা আমার জানা নেই। অথচ আমরা বাঙালি জাতি মাতৃভাষার জন্য মিছিল থেকে শুরু করে জীবন পর্যন্ত দিয়েছি। যার কারণে বাংলা আজ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ হিসেবে স্বীকৃত। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালন করে। ভাষাভাষি জনগণের দিক থেকে বাংলা বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ ভাষা। বাংলা ভাষায় শুধু বাংলাদেশ নয়; ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার এবং মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলের প্রায় সাড়ে চব্বিশ কোটি মানুষ কথা বলে।
বিশ্বের বুকে বাংলা ভাষার যে সম্মান; তা আমরা বাঙালি হয়েও রক্ষা করতে পারছি না। আমরা ভুলে যাচ্ছি আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অশুভ প্রভাবের ফলে বাঙালি জনগণ তাদের মাতৃভাষা বাংলাকে এখন তুচ্ছ মনে করে। বিশেষ করে নগরে বা শহরে বসবাসরত শিক্ষিত জনগোষ্ঠির মাঝে এই বিষয়টি অতিমাত্রায় লক্ষণীয়। শিক্ষিত জনগোষ্ঠি মনে করেন, বিদেশি ভাষা না শিখলে বা বিদেশি ভাষায় কথা না বললে তাদেরকে শিক্ষিত মনে করেন না। নিজেকে জ্ঞানী হিসেবে জাহির করতে গিয়ে তারা যে মাতৃভাষাকে কতটা অবমাননা করছে তা বোধহয় তারা কখনো ভেবেও দেখেনি।
Advertisement
বাংলার সঙ্গে বিদেশি ভাষার অবাধ ব্যবহারসহ ভুল লেখা ও উচ্চারণের ফলে বাংলা ভাষা আরও বিকৃত হচ্ছে। ফলে সঠিক বানান ও উচ্চারণ নিয়ে সংশয়ে ভুগছে শিক্ষার্থীরা। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত এমনকি উচ্চতর পর্যায়েও প্রকৃত বাংলা ভাষা শিখতে এবং ব্যবহারে বিব্রত হচ্ছে। বাংলা ভাষার সঙ্গে বিদেশি ভাষার মিশ্রণ ও এর অবাধ ব্যবহার আমাদের মাতৃভাষাকে কলুষিত করছে। পণ্যসামগ্রীর মোড়ক থেকে শুরু করে উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি কর্মস্থলেও বাংলা বানান, উচ্চারণ ও ব্যবহারে অসংখ্য ভুলের ছড়াছড়ি। সঠিক শব্দ না জেনে ভুল শব্দ বা বানানকে শুদ্ধ মনে করে ব্যবহার করা হচ্ছে। যা মোটেও কাম্য হতে পারে না। অথচ কতিপয় সচেতন ব্যক্তি ব্যতীত তেমন কারো এ বিষয় নিয়ে মাথাব্যথা নেই।
প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’ শহীদ মিনারের পাদদেশে পুষ্পার্পণসহ ভাষা শহীদদের স্মরণে আবেগাপ্লুত হওয়া ছাড়া তেমন কিছু দেখছি না। তারা কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে খালি পায়ে শহীদ মিনারে রওনা হয়। সেদিন মনে হয় বাঙালির মাতৃভাষা সার্থক এবং সফলতম একটি ভাষা। কিন্তু পরদিন থেকেই সে মাতৃভাষাপ্রেম তাদের মাঝে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কোথায় গেল সে ভাষাপ্রেম? কোথায় তাদের আবেগ? কখনো কি প্রশ্নটা জেগেছে আপনার কাছে? বাঙালি জাতি হিসেবে এ চির শ্যামল বাংলার মাটিতে জন্মে মাতৃভাষাকে নিয়ে একটু কি ভাবা উচিত নয়?
তবে সম্প্রতি একটি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে জাগো নিউজ। তাদের এ পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাতে হয়। দেশের অন্যতম নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কম প্রাণ গ্রুপের সহযোগিতায় একটি ক্যাম্পেইন শুরু করেছে। বাংলাকে জাতিসংঘের ৭ম দাফতরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার দাবিতে চলছে ‘জাতিসংঘে বাংলা চাই’ অনলাইন ক্যাম্পেইন। ১ ফেব্রুয়ারি ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এ ক্যাম্পেইনের শুভ উদ্বোধন করেন। এ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে আবেদন (www.jagonews24.com) করতে পারবেন আপনিও।
অবশেষে বলতে চাই- মাতৃভাষার শুদ্ধ প্রয়োগ এবং উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে প্রত্যেকের উচিত মাতৃভাষা সম্পর্কে জানা এবং অন্যকে জানানো। তবেই ভাষা শহীদদের ত্যাগ সার্থক হবে। আমরা যেন ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। এবারের ভাষা দিবসে আমরা নবোদ্যমে জেগে উঠবো- এমনটি সবার কাছে প্রত্যাশা।
Advertisement
এসইউ/এমএস