জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য শেরপুরের মেয়ে ফাতেমাতুজ্জহুরা শ্যামলী। যশোরের বর্তমান পুলিশ সুপার আনিসুর রহমানের সাথে বৈবাহিক সূত্রে তিনি এখন গোপালগঞ্জের বধূ। প্রায় সাত মাস আগে শ্যামলী-আনিস দম্পতির কোলজুড়ে আসে এক ফুটফুটে কন্যাশিশু। আদর করে বাবা-মা নিজেদের সাথে মিলিয়ে মেয়ের নাম রাখেন ‘আনিসা ফাতেমা সংসদ ওরফে আদরজান’। সুদূর আমেরিকার হাসপাতালে সন্তানের জন্ম এবং স্বামী-সংসার, সংসদের নানা ব্যস্ততার কারণে প্রায় দুই বছর যাবত নিজ এলাকা শেরপুর আসা হয়নি সংসদ সদস্য ফাতেমাতুজ্জহুরা শ্যামলীর। তাই নানাবাড়িও দেখা হয়নি শিশুকন্যা আদরজানের। অবশেষে বাবা-মায়ের সাথে গত মঙ্গলবার (৬ মার্চ) বিকেলে শেরপুরে আগমন ঘটে আনিসা ফাতেমা সংসদ ওরফে আদরজানের। আদরজানের এই আগমনের খবর নিয়ে জেলার সর্বত্র চলছে সরব আলোচনা। শহরবাসী তার আগমনকে রাজসিক আগমন বলে অভিহিত করছেন।
রাজসিক আগমন এজন্য বলা হচ্ছে যে, রাজধানী ঢাকা থেকে সড়কপথে নকলায় পৌঁছার পর শেরপুর শহর থেকে হাতি-ঘোড়ার সওয়ারসহ শতাধিক মাইক্রোবাস, অর্ধশতাধিক ট্রাক এবং প্রায় ৬/৭ শ’ মোটরসাইকেল বহর তাদের এগিয়ে নিয়ে আসে। সন্ধ্যায় শহরের নবীনগর মোড়ে পৌঁছলে রাস্তার দু’পাশে থাকা ভক্ত-উৎসুক জনতাসহ হাজার হাজার মানুষ তাদের স্বাগত জানায়। আদরজানকে কোলে নিয়ে নিজের গাড়ির হুড খুলে সংসদ সদস্য শ্যামলী দু’হাত নেড়ে উৎসুক জনতাকে শুভেচ্ছার জবাব দেন। এরপর শহরের ঢাকলহাটি এলাকায় নানাবাড়িতে পৌঁছায় আদরজান। আদরজানের নানাবাড়ি ঢাকলহাটির পুরো এলাকাকেই এজন্য আলোকসজ্জায় পরিণত করা হয়েছে। রাতের আধাঁরে জ্বলছে নানা রং-বেরংয়ের বাতি।
আদরজানের আগমন উপলক্ষে নকলা উপজেলা সদর থেকে জেলা শহরের ঢাকলহাটি এলাকা পর্যন্ত রাস্তায় বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা-স্বাগতম ব্যানারসহ প্রায় অর্ধশতাধিক তোরণ নির্মাণ করা হয়। আদরজানকে নিয়ে সম্প্রতি তার মা সংসদ সদস্য ফাতেমাতুজ্জরা শ্যামলী এবং বাবা পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রী আদরজান ও তার বাবা-মাকে নিয়ে ছবি তোলেন। প্রতিটি তোরণে শোভা পাচ্ছিল প্রধানমন্ত্রীর কোলে ‘আদরজান’ আর দুই পাশে তার বাবা-মা দাঁড়িয়ে থাকার সেই ছবিটিও। এজন্যই শহরবাসী আদরজানের এ নানাবাড়ি আগমনকে ‘রাজসিক’ বলে উল্লেখ করছেন।
এদিকে, আনিসা-ফাতেমা সংসদ আদরজানের নানাবাড়িতে আগমন উপলক্ষে তার জন্য দোয়া ও প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়েছে। আগামীকাল (৮ মার্চ) শহরের ঢাকলহাটি এলাকায় প্রয়াত শ্রমিক নেতা সেলিম রেজার বাড়িতে এ দোয়া ও প্রীতিভোজ অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে শহরবাসী এ প্রীতিভোজকে ‘রাজকীয়’ প্রীতিভোজ বলে আখ্যায়িত করছেন।
শোনা যাচ্ছে, সংসদ সদস্য শ্যামলীর প্রয়াত বাবা শ্রমিক নেতা সেলিম রেজার নাম ও খ্যাতি এবং নিজে সংসদ সদস্য হওয়ার সুবাদে স্থানীয় প্রায় ১০ হাজার মানুষকে প্রীতিভোজের জন্য দাওয়াত করা হয়েছে। একটি সূত্রে জানা গেছে, প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে এ ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, আদরজানের দুই ব্যবসায়ী মামা তাদের ভাগ্নির সম্মানে এ ভোজের আয়োজন করেছেন। সংসদ সদস্য ফাতেমাতুজ্জহুরা শ্যামলীর পক্ষ থেকে এই দোয়া মাহফিল ও প্রীতিভোজে অংশগ্রহণের জন্য দলীয় নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে দাওয়াতপত্র প্রদান করা হয়েছে।
এদিকে, স্বামী পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বিপিএম পিপিএম (বার) ও কন্যা আদরজানসহ অ্যাডভোকেট ফাতেমাতুজ্জহুরা শ্যামলী এমপির আগমন উপলক্ষে মঙ্গলবার রাতে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জেলা পরিষদের সম্মেলন কক্ষ নিসর্গে আয়োজিত ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অ্যাডভোকেট ফাতেমাতুজ্জহুরা শ্যামলী এমপি স্বামী, সন্তান ও তার জন্য সকলের কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন। সংবর্ধনার জবাবে তিনি বলেন, শেরপুরের মাটি মানুষের ভালোবাসায় গড়ে উঠেছি। মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত শুভেচ্ছা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি। এজন্য আমৃত্যু শেরপুরকে ভালোবেসে মানুষের সেবা করে যেতে চাই।
জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর রুমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. ছানুয়ার হোসেন ছানু। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম আঁধার, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শামছুন্নাহার কামাল, জেলা পরিষদ সদস্য ছানুয়ার হোসেন, অ্যাডভোকেট আল ফারুক ডিওন, জেলা যুবলীগের সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান হাবিব, কাজী মতিউর রহমান প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান বায়োযীদ হাছান।
অপরদিকে, বুধবার (৭ মার্চ) সকালে শেরপুর জেলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ফাতেমাতুজ্জহুরা শ্যামলীকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। সমিতির ২নং বার ভবন মিলনায়তনে আয়োজিত ওই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্য শ্যামলীকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। সে সময় অ্যাডভোকেট শ্যামলী এমপির পক্ষ থেকেও সমিতির নব-নির্বাচিত কর্মকর্তাদের বিশেষ সম্মাননা ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। সেইসাথে তিনি সমিতির লাইব্রেরি উন্নয়নে ৫ লাখ ও অন্যান্য খাতে আরও দেড় লাখ টাকার আর্থিক অনুদানের ঘোষণা দেন।
জেলা আইনজীবী সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম আধারের সভাপতিত্বে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. সিরাজুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট একেএম মোছাদ্দেক ফেরদৌসী, নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মাহবুবুল আলম রকীব, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইমাম হোসেন ঠান্ডু, এমকে মুরাদুজ্জামান প্রমুখ। পরে ফাতেমাতুজ্জহুরা এমপি আইনজীবী সমিতির নবনির্মিত লাইব্রেরি ও ইনডোর গেমস কক্ষের ফলক উন্মোচন করেন। জেলা বার সভাপতি অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম আধার জানিয়েছেন, জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হিসেবে সংসদ সদস্য ফাতেমাতুজ্জহুরা শ্যামলীকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছে।
আদরজানের বাবা মো. আনিসুর রহমান (পিপিএম বার) বিগত সময়ে শেরপুর জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। যে কারণে তারও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী-শুভানুধ্যায়ী রয়েছেন। মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার পর্যন্ত সংসদ সদস্য ফাতেমাতুজ্জহুরা শ্যামলীর বাসায় শত শত নেতাকর্মী, ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ীর আগমন ঘটায় তিনি ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে স্বামী-সন্তানসহ সংসদ সদস্য ফাতেমাতুজ্জহুরা শ্যামলীর এমন ঢাক-ঢোল পিটিয়ে শেরপুর আগমনকে ঘিরে স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝড় শুরু হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানিয়েছে, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হুইপ আতিউর রহমান আতিকের হাত ধরেই সংসদ সদস্য ফাতেমাতুজ্জহুরা শ্যামলীর রাজনীতিতে আগমন। শেরপুরে পুলিশ সুপার থাকাকালে সংসদ সদস্য ফাতেমাতজ্জহুরা শ্যামলীর স্বামী আনিসুর রহমানের সাথে হুইপ আতিকের শীতল সম্পর্ক ছিল রাজনীতিতে অন্যতম আলোচিত বিষয়। একপর্যায়ে শেরপুর থেকে বদলি হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান শ্যামলীকে বিয়ে করেন। এবার সংসদ সদস্য শ্যামলী শেরপুরে আগমনের পর হুইপ আতিকবিরোধী আওয়ামী লীগ নেতারা তাকে সংবর্ধনা দিয়েছেন। এতে আদরজানের রাজসিক আগমন ও রাজকীয় ভোজ স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সামনের দিনগুলোতে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে বলে রাজনৈতিক মহলে নানা গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
হাকিম বাবুল/বিএ