দেশজুড়ে

৭৫ বছর পর বসু মিয়া খুঁজে পেলেন জীবনের দুটি ভুল

চোখের সামনে বদলে গেছে অনেক কিছু। পরাধীন দেশ হয়েছে স্বাধীন। ৭৫ বছর ধরে অনেক ইতিহাসের সাক্ষী তিনি। সব কিছু বললালেও শুধু বদলায়নি বসু মিয়ার (৭৫) জীবন। চার আনা রোজে দিনমজুরের কাজ শুরু করেছিলেন। সেই চার আনা থেকে ৩০০/৪০০ টাকা রোজ হয়েছে তবু নিজের জীবন থেমে আছে সেই চার আনাতেই। বুঝে গেছেন ৭৫ বছরের এই জীবনে কখনও ৮ আনা তার ভাগ্যে নেই। ১৬ আনা পরিপূর্ণ জীবন তার ছেলে-মেয়েরাও হয়তো এই জীবনে পাবে না। বসু মিয়া একজন দিনমজুর। মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাজিরবাজার সংলগ্ন পালপুর গ্রামে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের ভেতরে তার জরাজীর্ণ ঘর। ৪ ছেলে ৩ মেয়ে সবাই বিবাহিত। বড় ছেলে পরিবার নিয়ে আলাদা থাকে। বড় মেয়ের স্বামী মারা গেছে। মেঝো মেয়ে স্বামী পরিত্যক্তা সেও তার দুই মেয়েসহ বাবা বসু মিয়ার সঙ্গেই থাকে। সব মিলে ১৪ জনের পরিবার।

দুই ছেলে দিনমজুরের কাজ করে বাবার মতো। তবুও নুন আনতে পান্তা শেষ হয়। মৌলিক অধিকার পূরণ করা তো দূরের কথা, আজো হয়নি মাথা রাখার মতো নিজের এক খণ্ড জায়গা। নিজের ভূমি নেই তাই যে যখন দয়া করে থাকার জায়গা দেয় তখন সেখানেই পরিবার নিয়ে থাকেন। এ পর্যন্ত ৮ বার বাড়ি বদল করেছেন। পুরাতন ঘর ভেঙে স্থান পরিবর্তন করে নতুন ঘর তৈরি করতে বারবার বাঁধা পড়েছেন ঋণের জালে।

বর্তমানে ঘর তৈরি করেছেন পালপুর গ্রামের মনু নদীর পাড়ে। এই জায়গাটি স্থানীয় নজিব উদ্দিনের দখলে ছিল, কিন্তু বছর কয়েক আগে যখন আগের জায়গা থেকে বিতাড়িত হন তখন নজির উদ্দিন বসু মিয়াকে এ স্থানে ঘর বানানোর জায়গা দেন। এর আগে স্থানীয় সাবেক এক ইউপি চেয়ারম্যানের জায়গায় থাকতেন। বসু মিয়ার বউ জয়তুন বিবি (৬০) চেয়ারম্যানের বাড়িতে কাজ করতেন সেই সুবাদে থাকার জায়গা পেয়েছিলেন। কাজ শেষ, তাই থাকার জায়গাও শেষ। খরস্রোতা মনু নদী বর্ষায় কখন রূপ বদল করে বোঝার উপায় নেই, তাই যখন তখন পানিতে ডুবে যায় বসু মিয়ার ভিটা। গত বছরের বন্যাতে দীর্ঘদিন পানির নিচে ছিল বসু মিয়ার ঘর। বাধ্য হয়ে কাচা রাস্তার উপর থাকতে হয়েছে পরিবার নিয়ে। কাজ কাম ছিল না তাই সুদে ঋণ নিতে হয়েছে। সুদের টাকা পরিশোধ, তার উপর এত বড় পরিবারের খরচ সব কিছু মিলে অমানবিক জীবন যাপন করছেন বসু মিয়া।

৫ বছর ধরে বসু মিয়া শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না। অভাবের সংসার তাই নিজের চিকিৎসা করাতে পারছেন না। যখন অসুখ বেড়ে যায় তখন সুদে টাকা এনে চিকিৎসা করান, আবার সেই টাকা পরিশোধ করেন। পরিবারের যেকোনো বড় প্রয়োজনে ভরসা করতে হয় ঋণের টাকার উপর। সারা বছর ঋণের জালে বন্দি থাকেন তিনি। এক বছর হল বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন, কিন্তু তা দিয়ে তার নিজের ওষুধের দামই হচ্ছে না। বসু মিয়া জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে দুটি ভুলকে বড় করে দেখছেন। এক, বাল্য বিবাহ করার ফলে এতো বড় সংসার সৃষ্টি, দ্বিতীয়ত শিক্ষার অভাব। বসু মিয়া জাগো নিউজকে অশ্রুসিক্ত চোখে জানান, জীবনের ১২টি মূল্যবান বছর তিনি কাজ করে এক টাকাও পাননি। পার্শ্ববর্তী আমুয়া গ্রামের মৃত নবু উল্লাহর বাড়িতে একটানা ১২ বছর কাজ করেছেন, কিন্তু একসঙ্গে দেব, দিচ্ছি করে তাকে একটি টাকাও দেয়নি। সেখানে শুধু তিনবেলা খাবার আর ঘুমানোর জায়গা পেয়েছেন তিনি। এই ১২টি বছরের টাকা যদি তিনি পেতেন হয়তো জীবন আজ এমন হত না।

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি শেখ জুনেদ জামান জাগো নিউজকে জানালেন, ৪০ বছর যাবৎ বসু মিয়াকে দেখে আসছি অভাব-অনটনে জীবন টানতে। এখন বয়স হয়েছে তাই দিনমজুরের কাজও করতে পারেন না ঠিকমতো। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম আহমদ জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, তিনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন ভূমিহীনদের সরকার যে ভূমি দিচ্ছে সেখানে বসু মিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কীনা।

রিপন দে/এমএএস/আরআইপি