চাঁপাইনবাবগঞ্জের শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ট সেতুর আয়ুষ্কাল দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০ বছরে। আর সেটিও পেরিয়ে গেছে বহু আগেই। ওভার লোড যানবাহন পারাপারে এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সেতুটি এখন জরাজীর্ণ। সেতুজুড়ে দেখা দিয়েছে ছোট ছোট অসংখ্য ফাঁটল।
জেলা শহরের মহানন্দা নদীর উপর নির্মিত বাংলাদেশ-চীন তৃতীয় মৈত্রী এ সেতু সড়ক পথে সোনামসজিদ স্থলবন্দরকে যুক্ত করেছে। প্রতিদিনই কয়েক হাজার পণ্যবাহী যান পারাপার হচ্ছে এ সেতু দিয়ে। তবে সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) দাবি, পরিস্থিতি এখনও ততোটা বিপজ্জনক নয়।
প্রায় ২৬ বছর আগে ১৯৯৩ সালের ২৩ জুন যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় এ মহানন্দা সেতু। চীনা প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ হওয়ায় এর প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল জানাতে পারেনি সওজ।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা ধরে নিচ্ছেন ৪৪৮ দশমিক ৩ মিটার দীর্ঘ এ সেতুটির প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল পঞ্চাশ বছর। এ সেতুতে ডাবল এক্সেল যানের অনুমোদিত লোড ১৫ থেকে ২২ টন। কিন্তু প্রতিদিনই ৪৪ থেকে ৫০ টন ওজন নিয়ে বিপুল সংখ্যক যান এ সেতু পার হচ্ছে। অন্তত পাঁচ বছর দিগুন লোড নিয়ে যানবাহন পারাপার হলে সেতুর আয়ুষ্কাল পাঁচ ভাগের এক ভাগে নেমে আসে। সে হিসেবে এই সেতুর আয়ুষ্কাল ১০ বছরে নেমে যাওয়ার কথা।
এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এজেডএম ফারহান দাউদ। তবে এখন এর আয়ুষ্কাল ঠিক ক’বছর তা নিশ্চিতে বিষেশজ্ঞ মত প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তিনি।
জানতে চাইলে প্রকৌশলী ফারহান বলেন, বর্তমানে পুরো সেতুর ওয়ারিং সার্ফেসে অসংখ্য ছোট ছোট ফাটল দেখা দিয়েছে। সংযোগ পাত ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সম্প্রতি মেরামতও করা হয়েছে। উদ্বেগের কথা জানিয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে চীনা নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন তারা। অচিরেই সেতুতে বড় ধরনের সংস্কার কাজ করবে চীনা কর্তৃপক্ষ।
এদিকে ২০১৭ সালের এপ্রিলে সেতুটির টোল আদায়ে জরিপ চালায় সওজ। তাতে দেখানো হয়েছে, এক সপ্তাহে এক হাজার ৮৩৫টি ভারি ট্রাক এ সেতু অতিক্রম করেছে। গড়ে প্রতিদিন এ সংখ্যা ২৬২টি। আর প্রতিদিন ৫৩৫টি হারে একই সময় সেতু পারাপার হয়েছে তিন হাজার ৭৪৬টি মাঝারি ট্রাক। গত প্রায় এক দশক ধরে সোনামসজিদ বন্দর থেকে পাথর নিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে পাড়ি দিচ্ছে ভারি ও মাঝারি এসব ট্রাকগুলো। প্রতি বছর এসব যানবাহন বাড়ছে ৭ শতাংশ হারে।
তবে ওজন পরিমাপক না থাকায় ওভার লোড শনাক্ত করতে পারেনি সওজ। আর এ সুযোগে মহাসড়কে বেড়েছে ওভার লোড নিয়ে যান চলাচল। লোড নিয়ন্ত্রণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ মহাসড়কে বসানো বহনযোগ্য ওজন পরিমাপক অকেজো প্রায় আড়াই বছর ধরে। প্রায় ৬৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট সড়কের কয়লাবাড়ি পয়েন্টে বসানো হয় এটি। কিন্তু চালুর ২৫ দিনের মাথায় কারিগরি ত্রুটির কারণে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। অতিরিক্ত ওজনের যানবাহন ওঠানোর ফলে এটি নষ্ট হয়ে গেছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
তবে স্থায়ী ওজন পরিমাপক বসানোর প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানিয়েছেন সওজের রোড ডিজাইন ও সেইফটি সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ফজলুল করীম। তিনি বলেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে তারা স্থানীয় ওজন পরিমাপক বসাবেন। এ প্রকল্পটি এখন মন্ত্রণালয়ে। একনেকের চূড়ান্ত অনুমোদন পেলেই প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হবে। আগামী জুলাইয়ে এ কাজ শুরুর ব্যাপারে আশাবাদী তিনি।
তিনি আরো বলেন, এ অঞ্চলের সড়ক ও সড়ক অবকাঠামোগুলো যেসব কারণে দ্রুত নষ্ট যাচ্ছে তার অন্যতম কারণ ওভার লোড। তবে ওজন পরিমাপক না থাকায় রাজশাহী অঞ্চলের ওভার লোড যানবাহন চলাচল সংক্রান্ত কোনো তথ্যই নেই তাদের কাছে।
অন্যদিকে আঞ্চলিক সড়ক দফতর বলছে, কেবল ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর সেতুই নয়, এ অঞ্চলের সড়ক-মহাসড়কগুলোর পেভমেন্ট ও সোল্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। সড়কজুড়ে সৃষ্টি হচ্ছে ছোটবড় অসংখ্য খানাখন্দ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যান্য ব্রিজ ও কালভার্টগুলো। সড়কগুলো জোড়াতালি দিয়ে কোনোরকমে সচল রাখা হচ্ছে। সওজের রাজশাহী জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবু রওশন বলেন, সড়কগুলোর যে অবস্থা তাতে দীর্ঘ মেয়াদে কাজ না করলে সুফল মিলবে না। আর এজন্য ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামতে ২৭৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকার পরিকল্পনা নিয়েছে সড়ক বিভাগ। এর আওতায় ওই ৭০৬ দশমিক ৭০ কিলোমিটার সড়কেরই পেভমেন্ট মজবুতিকরণসহ সার্ফেসিং করা হবে।
তবে সোনামসজিদ বন্দরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ঠিক রাখতে মহানন্দায় দ্বিতীয় সেতুর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন রাজশাহী সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীতি কুমার চাকমা। এর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সওজের নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, স্থলবন্দরের সঙ্গে দেশের সড়ক যোগাযোগ চালু রাখতেই আলাদা সেতুর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। ওই পরিকল্পনায় রাজশাহী নগরীর নওদাপাড়া আমচত্বর থেকে সোনামসজিদ বন্দর পর্যন্ত ৮৬ কিলোমিটার চার লেন মহাসড়ক নির্মাণও থাকছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।
বিষয়টি স্বীকার করে এসএএসইসি সড়ক যোগাযোগ প্রকল্প-২ এর উপপ্রকল্প পরিচালক ও নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থ দাস গুপ্ত বলেন, হাটিকুমরুল থেকে রাজশাহী হয়ে সোনামসজিদ স্থলবন্দর পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হবে। তাতেই রয়েছে মহানন্দা নদীর উপর সতন্ত্র সেতু। জাতীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এটির নকশা হয়েছে। তবে কবে নাগাদ এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি এই প্রকৌশলী।
এফএ/এমএস