দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, দুর্নীতির ১১৮ মামলায় পুরুষের পাশাপাশি নারীদের সাজার বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে দুর্নীতি দমন কমিশনকে। স্বামীর দুর্নীতির বিষয় জানেন না এমন নারীর সাজা কিভাবে দেয়া সম্ভব? তাদের সাজা থেকে নাজাত দেয়া বা দায় মুক্তির বিষয়ে আইনের সংশোধন-সংযোজন করা যায় কি-না, তা নিয়ে আইনজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করবে দুদক।
রোববার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে মাইডাস সেন্টারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) সম্মেলন কক্ষে এক মতবিনিময় সভায় একথা বলেন তিনি।
টিআইবি কার্যালয়ের মেঘমালা সম্মেলনকক্ষে ‘দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত আয় ও সম্পদের পারিবারিক দায়: নারীর ভূমিকা, ঝুঁকি ও করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ইকবাল মাহমুদ বলেন, নারীর স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন রয়েছে এমন দেশই টেকসই উন্নতি করছে। অনেক দেশ খুব ধনী কিন্তু তাদের নারীর ক্ষমতায়ন বা স্বাধীনতা খুব কম। সেখানে উন্নতি হলেও টেকসই নয়।
তিনি বলেন, ৬০/৭০ লাখ টাকার দুর্নীতির মামলায় কয়েক বছর আগে এক মেডিকেল কলেজপড়ুয়া নারী দোষী সাব্যস্ত হওয়ার বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি জানেনই না স্বামীর সঙ্গে তিনিও দুর্নীতির মামলায় সাজা পেতে যাচ্ছেন। ওই বিষয়টি খুবই চিন্তার বিষয়। এ রকম ১১৮টি দুর্নীতির মামলায় নারীর সাজা হওয়ার সম্ভাবনাটি খুবই নেতিবাচক।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘একজন নারী জানেন না তার স্বামীর দুর্নীতি। অথচ তাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তার (স্ত্রীর) নামে-বেনামে স্বামীর অবৈধ অর্জিত সম্পদ ব্যাংকে যাচ্ছে কিংবা কোনোভাবে লেনদেন হচ্ছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত আয় সম্পর্কে ওই নারীর না জানাটাও দুঃখজনক। আইনে কিংবা আদালতে ওই নারীকে রক্ষায় কিছু করার থাকে না।’
ইকবাল মাহমুদ বলেন, অনিচ্ছায় দুর্নীতির মামলায় জড়ানো নারীদের কিভাবে সাজা দেয়া সম্ভব? তাদের নাজাত দেয়া কিংবা দায়মুক্তির কোনো পথ বের করা যায় কি-না তা নিয়ে আলোচনা চলুক। সর্বমহলে আলোচনা হলে এটা নিয়ে সাড়া পড়বে। এ নিয়ে আইনজীবী, আইনের শিক্ষকসহ আইনজ্ঞদের সঙ্গেও পরামর্শ করা হবে। প্রয়োজনের সংশ্লিষ্ট আইনের সংশোধন ও সংযোজনও করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, দুর্নীতি কমাতে নারীরা মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। সেখানে নারীরাই যদি দুর্নীতির মামলায় সাজা পায় তবে দুর্নীতি রুখবো কী করে? আমি সকল নারীর প্রতি আহ্বান জানাবো, দুর্নীতিগ্রস্ত স্বামী সম্পর্কে সচেতন হন। আপনার স্বামীর অর্জিত সম্পদ সম্পর্কে সচেতন হন। ব্যাংকের কোনো কাগজে কিংবা ব্ল্যাংক চেকে স্বাক্ষর করার আগে ভালো করে জানবেন কেন-কিসের জন্য আপনার স্বাক্ষর নেয়া হচ্ছে। দুর্নীতির বড় জায়গা হচ্ছে ফ্ল্যাট কেনা ও জমি কেনা। কোটি টাকার সম্পত্তি ১০ লাখে কেনা যাচ্ছে কিভাবে? জমি ও ফ্ল্যাটের দাম নির্ধারণের বিষয়টি অনেক দিন ধরেই আলোচনা করে আসছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে এ ব্যাপারে এখনো কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল, নারী নেত্রী ও মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির, অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর।
আসিফ নজরুল বলেন, সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও সরকারি আমলা-কর্মকর্তাদের নাম বেশি আসছে দুর্নীতির মামলায়। যেসব দুর্নীতির মামলায় নারীর নাম জানা যাচ্ছে, তাদের স্বামীরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং নারীরা কি এত অবলা? আমার মা ফাইভ পাস ছিলেন। কিন্তু তার কারণে আমার বাবার সাহস ছিল না দুর্নীতি করার।
খুশি কবির বলেন, সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন নেই। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে নারীদের দাম দেয়া হচ্ছে না। সমান অধিকার তো দূরের কথা অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া ও নির্যাতন করা হচ্ছে নারীদের। যে কারণে দুর্নীতি বাড়ছে। স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে নারীর নামও দুর্নীতি মামলায় ঢুকে যাওয়ায় নারীর সচেতনতা অনেককাংশে দায়ী।
ফারাহ কবীর বলেন, নারীদের মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের পারিবারিক শ্রমের পারিশ্রমিক তারা পান না। এটা নিশ্চিত করা দরকার। স্বামীর বৈধ ও অবৈধ আয়ের ব্যাপারে স্ত্রীরা যেমন বাধা দেবে তেমনি নিজেরাও দুর্নীতি সচেতন হতে হবে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আইনের সংশোধন আনা যেতে পারে। দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা বাড়াতে প্রচার-প্রচারণা জরুরি। দুদককে আরও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করা দরকার। নারীরা অবলা নয়। নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর মূল্যায়ণ ও সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতার পরিবেশ তৈরি করা গেলে কমে যাবে দুর্নীতি।
জেইউ/এনএফ/এমএস