দেশজুড়ে

ত্রাণ লুটে ওরা, আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে কী করব

‘নয় লাখ টাকা দিয়ে জায়গা কিনে ঘর করেছিলাম। গেল বছর পাহাড় ভাইঙা সেই ঘর পাঁচ মিনিটেই শেষ হয়ে গেছে। সরকার নাকি অনেকরে অনেক কিছু দিছে, আমি একবান টিনও পাই নাই। তাই এবার আর আশ্রয় কেন্দ্রে যামু না। মরলে নিজের ঘরেই মরমু। কারও দুয়ারে যাইতে চাই না।’

২০১৭ সালের ১৩ জুন পাহাড় ধসে বাড়ি হারানো মজিদ মিয়া এভাবেই মঙ্গলবার (১২ জুন) দুপুরে জাগো নিউজের কাছে তার ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন। বৃষ্টিতে-ঝুঁকিতে থেকেও কেন আশ্রয় কেন্দ্রে জাননি, প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে এভাবেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন দিনমজুর মজিদ মিয়া। তার ধারণা আশ্রয় কেন্দ্রে ‘ত্রাণ’ দেওয়া হয়।

শুধু মজিদ মিয়া নয়। শুক্রবার থেকে বৃষ্টি শুরুর পর থেকে পাহাড় ধসের হুমকিতে থাকা অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে এভাবে অনীহা প্রকাশ করেন। এদের কেউ কেউ গতবার ত্রাণ না পাওয়ায় এবার আর আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে চান না। আবার অনেকে নিজের বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে জেতে রাজি নন। তারা বলছেন, মরতে হলে এখানেই মরবেন। তবুও পাহাড় ছেড়ে যাবেন না।

ত্রাণ নিয়ে অনিয়মে এভাবেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন নতুন পাড়ার বাসিন্দা মজিদ মিয়া।

অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, ২০১৭ সালে পাহাড় ধসের পর ক্ষমতাশীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর ছত্রছায়ায় যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছিল, তা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা পাননি।

মঙ্গলবার (১২ জুন) দুপুরে রাঙ্গামাটির নতুনপাড়া, মুসলিমপাড়া ও বরাদম-মনোঘর এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, প্রবল বৃষ্টির মাঝেও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত মানুষরা তাদের ঘর ছেড়ে যাচ্ছেন না। জানতে চাইলে কেউ কেউ বলছেন, রাতে যাব। আবার কেউ বলছেন, তারা ঘর ছেড়ে যাবেন না।

মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকার পরেও ঘর ছেড়ে যেতে নারাজ ঝিনুক ও হাফসা বেগম।

মৃত্যুঝুঁকি থাকার পরেও মানুষ কেন পাহাড় ছেড়ে যাচ্ছেন না, তার কারণ জানার চেষ্টা করেছে জাগো নিউজ। নতুন পাড়ার বাসিন্দা শাহ জামাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা কেন আশ্রয় কেন্দ্রে যাব? গেল বছর ঘর ভাঙল আমাদের, ত্রাণ পেল মুখ চেনারা। এখানে সরকারদলীয় লোকের পেছনে পেছনে যারা ঘোরে না, তারা ত্রাণ পায় না। তাই ঝুঁকিতে থেকেও আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এবার আর আশ্রয় কেন্দ্রে যাব না।’

সোমবার রাতের বৃষ্টিতে ঘর ভেঙ্গে গেছে সরফ বানুর। তিনি তার গর্ভবতী মেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন পাশের বাড়ির ভাড়া বাসায়। গত বারের অনিয়মের প্রতিবাদ করে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘গতবার আমার ঘরটা পুরো ভাঙেনি। এবার পুরোটাই ভেঙেছে। অন্তত পঞ্চাশ পরিবার গতবছর ক্ষতিপূরণ পেয়েছে; যাদের অধিকাংশেরই কোনো ক্ষতি হয়নি। অথচ আমার আধা ভাঙা ঘরে বছর পার করে দিলাম। কেউ এক টাকা সাহায্য করেনি। ঘর যখন ভেঙেই গেছে, তাই এবার আর ওদের সাহায্য চাই না।’

নতুনপাড়ার বাসিন্দা ঝিনুক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসামবস্তির মহিলা মেম্বার আজ (মঙ্গলবার) সকালে ১০টি কার্ড পাঠিয়েছে। প্রতিটি কার্ডে ১০ কেজি করে চাল দেয়া হবে। কিন্তু এই পাড়ায় অন্তত দুইশ’ পরিবার আছে যারা কোনো না কোনো ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সেখানে কীভাবে ১০ জনকে আলাদা করে কার্ড দেয়া হয়? এখানে যারা কার্ড নিয়ে এসেছে, তারা তার নিজের লোকদেরই ওই কার্ড দিচ্ছে। আমরা যারা সাধারণ তারা কখনওই কিছু পাই না।’

শাহ্ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনের পাহাড়ি অংশে ধসের ঘটনা ঘটে।

তিনি আরও বলেন, ‘গতবছর পাহাড় ধসের পর সরকারসহ বিভিন্ন সংস্থা নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে। প্রায় তিনমাস আশ্রয় কেন্দ্রে থাকার পর একবস্তা চাল আর এক হাজার টাকা ছাড়া আর কিছুই মেলেনি। পরে প্রায় ছয়মাস ভাড়া বাসায় থেকে পঁচিশ হাজার টাকা ঘর ভাড়া দিয়েছি। এবার আর সেই সামর্থ নেই। তাই মরতে হলে এখানেই মরব। তবুও পাহাড় ছেড়ে যাব না।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘এখানে আমাদের আত্মীয়-স্বজন মারা গেছে, ঘর ভেঙেছে। কিন্তু লাভ হয়েছে তথাকথিত নেতাদের। আমরা যারা পাহাড়ের ভেতর আছি, তারা কিছুই পাইনি। যত ত্রাণ এসেছে তা শহরের রাস্তাতেই শেষ হয়ে যেত।’

শুধু নতুন পাড়া বা মুসলিমপাড়া নয়। ত্রাণ বিতরণে এমন অনিয়মের অভিযোগ সবখানেই। মো. হাসান নামে একজন নিজেকে শ্রমিক লীগ নেতা দাবি করে বলেন, ‘গতবার আমরা নিজের হাতে ত্রাণ দিয়েছি। চেষ্টা করেছি সবাইকে দেয়ার। তবে হ্যাঁ, অনেক প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা কিছুই পান নাই, আবার ভালো মানুষরা ত্রাণ নিয়ে চলে গেছে। আসলে বাঙালিরে কোনো কিছুতেই পেট ভরে না।’

‘সকালে ম্যাজিস্ট্রেট এসে সবাইকে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে বলেছে, কিন্তু কেউতো যায় না। এবার কারা ত্রাণ দিচ্ছে জানি না, আমি এবার ওসবের সঙ্গে নাই।’ যোগ করেন শ্রমিক লীগ নেতা হাসান।

গতবছর রেডক্রিসেন্টের পক্ষে ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছে এমন একজন নাম না প্রকাশের শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসলেই বিগত সময়ে ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। তাই ভুক্তভোগীরা ওইসব চেনামুখদের আর বিশ্বাস করতে চাইছেনা। প্রশাসনের উচিত প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে নিয়মমাফিক ত্রাণ তৎপরতা চালানো।’

ভেদভেদি নতুন পাড়া এলাকায় সফর আলী নামে একজনের বসতঘর পাহাড়ের চুড়া থেকে ভেঙ্গে পড়েছে।

রাঙ্গামাটি রেডিও স্টেশন এলাকার পাহাড়ে হাসিনা বেগম নামে এক নারীকে পাহাড়ের মাটি কেটে তার কাঁচা ঘরের চারপাশে দিতে দেখা গেল। ‘আশ্রয় কেন্দ্রে যাবেন না?’ প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গরু-ছাগল আছে, এগুলো ছেড়ে কেমনে যাই। গেলে কি আর এসব থাকব, চুরি হয়ে যাবে। যে যার ধান্ধায় থাকে। ঘর ছাড়লেই চোরের দল সব নিয়ে যাবে। তাই এখানেই থাকব। তবে রাতে আমরা কেউই ঘুমাই না। পালা করে পাহারা দিই।’

মঙ্গলবার দুপুর একটার দিকে মনোঘর এলাকার যুব উন্নয়ন ভবন আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ওই কেন্দ্রে কেউ আসেন নি। কেন্দ্রের ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর বিপুল চাকমা জানান, সব ব্যবস্থা থাকলেও এবার কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে আসছেন না। যদিও গত বছর প্রায় ৫শ’ পরিবার এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। দুপুর দুইটার দিকে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়েও একই দৃশ্য চোখে পড়ে।

তবে আমাদের রাঙামাটি সংবাদদাতা জানান, বৃষ্টি শুরুর পর থেকে আবারও পাহাড় ধসে পড়তে পারে এমন আশঙ্কায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২১টি অস্থায়ী আশ্রয় ক্যাম্প খোলা হয়েছে। জেলার ২১টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ১১০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।

২০১৭ সালের ১৩ জুন রাঙ্গামাটির নতুনপাড়ার এই জায়গায় পাহাড় ধসে নিহত হন একই পরিবারের ৭ জন।

এদিকে সোমবার দিবাগত রাত থেকে রাঙ্গামাটির বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। নানিয়ারচর উপজেলায় ভারী বর্ষণে পাহাড় ধসে মাটি চাপা পড়ে ১১ জন নিহত হয়েছেন। ভেদভেদি নতুন পাড়া এলাকায় সফর আলী নামে একজনের বসতঘর পাহাড়ের চূড়া থেকে ভেঙে পড়েছে। তবে পাহাড় ধসের আসঙ্কায় এর আগের রাতেই পরিবার নিয়ে সরে পড়েন সফর আলী। তাই জানমালের কোনো ক্ষতি হয়নি।

এছাড়া রাঙ্গামাটি সদরের তবলছড়ি ডিএসবি কলোনী এলাকার শাহ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনের পাহাড়ি অংশে ধসের ঘটনা ঘটে। এতে শিক্ষা প্রকৌশল কর্তৃক বিদ্যালয়ের নবনির্মিত ভবনটি ঝূঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

উল্লেখ্য, গত বছরে স্মরণকালের ভয়াবহতম পাহাড় ধসের ঘটনায় নিহত ১২০ জনের মধ্যে রাঙামাটি পৌরসভা ও সদর উপজেলাতেই মারা যায় পাঁচ সেনা সদস্যসহ ৭৩ জন। প্রশাসনের হিসেবে, সেবার পাহাড় ধসে জেলায় ১৮ হাজার ৫৫৮টি পরিবার কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১২৩১টি বাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত এবং ৯ হাজার ৫৩৭টি বাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এসআর/এমএস