বাহরাম খান
ইন্দিরা গান্ধী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক অবিস্মরণীয় নাম। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষ অবলম্বন করতে গিয়ে গোটা বিশ্বে তিনি যে অপমান ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলেন তা বিরল ঘটনা। কিন্তু তার অবদানের মতো উজ্জ্বল করে বাংলাদেশে তাকে কী আমরা স্মরণ করি? আজ ইন্দিরা গান্ধীর ৩২তম হত্যাবার্ষিকী, তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা। ইন্দিরা ভারতের পঞ্চম ও সপ্তম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
’৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী না থাকলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোনপথে এগিয়ে যেত তা বলা মুশকিল। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, ভবিষ্যত দেখতে পারার মতো দূরদৃষ্টি ও অনমনীয় নেতৃত্বের অধিকারী এই নেতার অবিস্মরণীয় আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোত প্রচেষ্টা তথা স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সফলতার জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইন্দিরা যেসব পদক্ষেপ নেন তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল আগস্ট মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতে মৈত্রী চুক্তি।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের প্রথমে ভারত সফরে এসে ইন্দিরা গান্ধীকে প্রচ্ছন্ন হুমকিই দিয়ে যান যে, পাকিস্তান যদি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সেটা শুধু ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ হবে না, সেই যুদ্ধে ভারতের বিরুদ্ধে চীনও যোগ দেবে। একই মাসের দ্বিতীয়ার্ধে কিসিঞ্জারের পাকিস্তান সফর ও গোপনে চীন সফরের পর ১৯৭২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্টের চীন সফরের ঘোষণা ইন্দিরাকে চিন্তিত করে তোলে।
একদিকে বিশাল শরণার্থীর বোঝা, অন্যদিকে পৃথিবী অন্যতম দুই ক্ষমতাধর দেশের পক্ষ থেকে যুদ্ধের হুঙ্কার। জোট নিরপেক্ষ বিশ্ব আন্দোলনের পুরোধা ভারত তখন অনেকটা অসহায় অবস্থা। কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে ইন্দিরা নিজেকে কখনো সাহসহীন করেননি। বিশ্বের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধরদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছেন দ্ব্যর্থহীনভাবে। তেমনি কূটনৈতিকভাবেও সবাইকে অবাক করে দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ৯ আগস্ট ঐতিহাসিক চুক্তিতে আবদ্ধ হন, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নতুন মাত্রা দেয়। নড়ে-চড়ে বসে মার্কিন-পাক-চীন নীতিনির্ধারকরা।
কিসিঞ্জার সোভিয়েত-ভারতের চুক্তিকে ‘বম্বশেল’ তথা ‘কামানের গোলা’ হিসেবে অভিহিত করেন। এই চুক্তির কারণেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে চীন কোনো প্রত্যক্ষ ভূমিকায় নামেনি। নামলে চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া চীনকে আক্রমণ করতো। উল্লিখিত এই চুক্তির দিন ইন্দিরা গান্ধী অনেকটা নির্ভার হয়ে দিল্লিতে ঐতিহাসিক এক জনসভায় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের সাফল্যের জন্য ও শরণার্থীদের দেশে ফেরার জন্য ভারত সব কিছু (প্রয়োজনে যুদ্ধ) করতে প্রস্তুত।
এর পরের মাসেই অর্থাৎ ২৮-২৯ সেপ্টেম্বর ইন্দিরা গান্ধী সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে সে দেশের শীর্ষ তিন নেতা ব্রেজনেভ, পোদগর্নি ও কোসিগিনের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও ভারত উপমহাদেশের শান্তি নিয়ে আলোচনা করে যৌথ বিবৃতি দেন। মার্কিন-পাক-চীন কুচক্রীদের ভিত কার্যত নাড়িয়ে দেয়।
দক্ষ ও দূর দৃষ্টিসম্পন্ন রাষ্ট্রনেতা হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী শুধু সোভিয়েতের সঙ্গে সম্পর্ক করেই ক্ষান্ত হননি। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম যে এদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং পাকিস্তানি ভূমিকা যে মানবতার বিরুদ্ধে, তা বুঝাতে ২৪ অক্টোবর দীর্ঘ ১৯ দিনের ইউরোপ-আমেরিকা সফরে বের হয়েছিলেন। সেই সফরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা কিসিঞ্জার ইন্দিরাকে যেভাবে ‘কূটনৈতিক অপমান’ করেছেন অন্তত তার জন্য হলেও বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে ইন্দিরাকে প্রতি বছর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা উচিত। কারণ একজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন রাষ্ট্রনেতা হয়েও বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাকে সব অপমান হজম করতে হয়েছিল।
দীর্ঘ বিদেশ সফরে বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক সমর্থন আদায়ের জন্য বের হলেও ইন্দিরা গান্ধী স্পষ্টতই ভবিষ্যত দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি জানতেন, এই সফর থেকে কোনো প্রাপ্তি হবে না। কিন্তু বিশ্বকে বুঝাতে হবে যুদ্ধের আগে আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক ছিলাম। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, ওই সফরে বের হওয়ার আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক।
২০ অক্টোবর কলকাতায় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী বৈঠক শুরু হলে সেখানেই বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানকে ইন্দিরা গান্ধীর দিল্লি আমন্ত্রণের কথা জানানো হয়। তারা তাৎক্ষণিক বৈঠক মুলতবি করে পরদিন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করেন।
সেই বৈঠকের বিষয়ে ‘মূলধারা:’৭১’ বইয়ে মঈদুল হাসান লিখেছেন, ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের শীর্ষ দুই নেতাকে বলেন, এই সফরের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোকে সম্মত করানোর বিষয়ে তিনি বিশেষ আশাবাদী নন। যদি কোনো সুফল নাই-ই পাওয়া যায় তবে তিনি ফেরত আসার পর পাকিস্তানি দখলদারদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থার (যুদ্ধের) কথা বিবেচনা করা হবে। পরবর্তীতে তাই করতে হয়েছিল।
এর আগে দীর্ঘ বিদেশ সফরের শেষ দিকে ফ্রান্সে এক সংবাদ সম্মেলনে ইন্দিরা গান্ধী কঠিন ভাষায় বিশ্বগণমাধ্যমে বলেছিলেন, পূর্ববাংলার একমাত্র সমাধান স্বাধীনতা, শিগগিরই হোক আর দেরিতেই হোক- এ স্বাধীনতা আসবেই। বাংলার মানুষের বুকের তাজা রক্তে ভেসে সেই স্বাধীনতা এসেছে। তবে বহির্বিশ্বে যারা সেই রক্তভেজা স্বাধীনতাকে স্বার্থক রূপ দিতে অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ইন্দিরা গান্ধীর অবদান- এ কথা অনস্বীকার্য।
এই মহান নেতার হত্যা দিনে তার আত্মার প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/পিআর