ছয় পাউন্ড গোলার চারটি কামান এবং দুটি অনিয়মিত অশ্বারোহী দল নিয়ে আজ থেকে ২২৪ বছর আগে ১৭৯৫ সালের ২৯ জুন পার্বত্য খাগড়াছড়ির সাবেক মহকুমা শহর সীমান্তঘেঁষা রামগড়ে গোড়াপত্তন হয় বর্তমান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি)। সপ্তদশ শতকের শেষভাগে পার্বত্য চট্টগ্রামে লুসাই বিদ্রোহ দেখা দিলে এ এলাকা রক্ষায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রামগড়ে ৪৪৮ জন সৈন্য নিয়ে ‘রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন’ গঠন করে। ‘রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন’ নামে যাত্রা শুরু করা এ ব্যাটালিয়ন আজ দেশের সীমান্ত রক্ষায় কাজ করছে।
ভারত সীমান্ত ঘেঁষা রামগড় উপজেলা সদরের অফিস টিলা এলাকায় অবস্থিত ‘রাইফেলস স্মৃতিস্তম্ভে’ লেখা রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সুদীর্ঘ বছরের সেই গৌরবোজ্জল জন্ম ইতিহাস। স্মৃতিস্তম্ভ বেদিতে বিজিবির জন্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লেখা ছাড়াও পোড়া মাটি দিয়ে তৈরি এ বাহিনীর বিবর্তনের ৮টি অবয়ব বা টেরাকোটা স্থাপন করা হয়েছে। ২০০৫ সালে তৎকালীন ৩৩ রাইফেল ব্যাটালিয়ন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবির সুতিকাগার রামগড়ে দৃষ্টিনন্দন এ স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করে। যা ওই বছরের ৬ জুন বাংলাদেশ রাইফেলস্ এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী উদ্বোধন করেন।
সময়ের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে এ বাহিনীতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ১৭৯৫ সালে ‘রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন’ নামে বাহিনীটির গোড়াপত্তন হওয়ার পর কালের বিবর্তনে পরিবর্তন হয় বাহিনীটির নামও। এ বাহিনীর বহরে ভারী অস্ত্রশস্ত্র যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি পরিবর্তন এসেছে পোশাকেও। সময়ের তাগিদে বৃদ্ধি পেয়েছে জনবল আর শক্তি সামর্থও।
১৭৯৫ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ বছর ‘রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন’ নামেই এ বাহিনীর কার্যক্রম চললেও ১৮৬১ সালে নিয়মিত-অনিয়মিত পুলিশ বাহিনীর সমন্বয়ে রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়নকে পুনর্গঠিত করা হয়। তখন এ বাহিনীর নামকরণ হয় ‘ফ্রন্টিয়ার গার্ডস’। যার সৈন্য সংখ্যা উন্নীত করা হয় ১ হাজার ৪৫৪ জনে। যার সদর দপ্তর ছিল চট্টগ্রামে। ওই সময় এ পার্বত্য এলাকায় লুসাই বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করলে ১৮৭১ সালে সৈন্য সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করা হয়। তখন লুসাই বিদ্রোহ দমন করে বাহিনীটি।
পরবর্তী সময়ে ১৮৭৯ সালে ‘ফ্রন্টিয়ার গার্ডস থেকে ‘স্পেশাল রির্জাভ বাহিনী’ নামে এ বাহিনীর সদস্যরা পিলখানায় প্রথম ঘাটি স্থাপন করে। সে থেকে পিলখানাকে ঘিরেই রাইফেলস্ এর সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৮৯১ সালে ‘বেঙ্গল মিলিটারি পুলিশ ব্যাটালিয়ন’ নামে আবির্ভূত হয় এ বাহিনী। সে সময় চারটি কোম্পানিতে বিভক্ত করা হয়। ১৯১২ সালে ‘ঢাকা মিলিটারি পুলিশ’, ১৯২০ সালে ‘বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন অব ইস্টার্ন ফ্যন্টিয়ার রাইফেলস্’। বাহিনীটির নাম আর পোশাক বদলের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ১৯৪৭ এ ভারত বিভক্তির পর এ বাহিনীর ‘ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস বা ইপিআর নামে পুরোদমে কাজ শুরু করে।
দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালের ৩ মার্চ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) থেকে নাম বদলে বাংলাদেশ রাইফেলস্ বা বিডিআর নামে আবির্ভূত হয়। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানা ট্রাজেডির পর ২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদে ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আইন-২০১০’ পাস হওয়ার মাধ্যমে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি নামে কাজ শুরু করে সীমান্তরক্ষী এ বাহিনী। ওই বছরে ২০ ডিসেম্বরকে বিজিবি দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।
বিজিবির জওয়ানদের আরও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে রামগড়ে রিক্রুটিং (লোকভর্তি) কেন্দ্র এবং বিজিবির জাদুঘর স্থাপনের দাবি জানিয়েছে রামগড়ের সচেতন মহল। রামগড়ের স্থানীয় সংবাদকর্মী মো. নিজাম উদ্দীন লাভলু বলেন, দেশ মাতৃকার সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নিয়োজিত এ বাহিনীর সুতিকাগার এ রামগড়েই। বিজিবি আর রামগড় অবিচ্ছেদ্য অংশ। রামগড়ের মাটিতে জন্ম নেয়া ‘রামগড় লোকাল ব্যাটালিয়ন’ থেকেই আজকের বিজিবি।
এদিকে দিবসটি পালনে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বিজিবি। সারাদেশের ন্যায় বিজিবির খাগড়াছড়ি ও গুইমারা সেক্টরসহ বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন আয়োজন করেছে বর্ণিল অনুষ্ঠানের। দিবসটি উপলক্ষে সেক্টর সদর দফতর ছাড়াও বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন সদরে দোয়া মাহফিল, পতাকা উত্তোলন, দরবার, প্রীতিভোজ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
মুজিবুর রহমান ভুইয়া/আরএআর/এমএস