মতামত

মানসম্মত বই এবং প্রকাশকের ভূমিকা

অরুণ কুমার বিশ্বাস

ওমর খৈয়াম যথার্থই বলেছেন, ‘রুটি-মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু একটি বই অনন্ত যৌবনা- যদি তেমন বই হয়!’ প্রিয় পাঠক, আমি এখানে সেই ‘তেমন বই’-এর কথা বলতে চাই। অর্থাৎ সুখপাঠ্য এবং মানসম্পন্ন একটি বই। প্রতিবছর একুশে বইমেলায় চার হাজারের বেশি বই প্রকাশিত হয়। আমরা সকলে জানি এবং মানি, এদের সিংহভাগ বই মোটেও সুপাঠ্য নয়, বরং ছাপানো কাগজ বলেই ধরা হয়। অথচ অবিরল বই বেরোচ্ছে, দেদার ছাপা হচ্ছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি। লোকে দোনমোনা করে হলেও সেসব বই কিনছে আর প্রতারিত হচ্ছে। ফলে যা হয় আর কি, যাঁরা সুলেখক তাদেরকেও পাঠক না পড়েই সেই এক কাতারে ফেলে দিচ্ছেন।

কেন এমন হচ্ছে! সমস্যা কোথায়! সোজা করে বললে, সমস্যা আসলে চালুনিতে। যারা লেখেন, তারা প্রত্যেকেই ভাবেন তার চেয়ে বড় ও প্রতিভাবান কোনো লেখক বুঝি আর পয়দা হয়নি। তিনিই সবচে ভাল লেখেন। তাই লেখক নিজে তার লেখার ওজন করবেন না, এটাই বরং স্বাভাবিক। চালে কাঁকড় আছে কি নেই, চালুনি দিয়ে সেই ‘চালার’ বা ছাঁকনের কাজটি কিন্তু প্রকাশকের। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি বেশির ভাগ প্রকাশক করেন না। করবেন যে, তাদের সময় কোথায়!

এ বিষয়ে প্রকাশকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রায়শ তারা লেখকের উপরেই দোষ চাপান। বলেন যে, লেখক সময়মতো পাণ্ডুলিপি জমা দেন না বলে ইচ্ছে থাকলেও তারা তা পড়ে দেখার ফুরসত পান না। ফলে ‘চালাচালিহীন’ (চালচুলোহীনও বলা যায়) কিছু প্রকাশক কিন্তু দিনশেষে সেই অপাঠ্য ভুলে ভরা বইই উপহার দিচ্ছেন বইমেলায়। আমি কিন্তু লেখক হিসেবে প্রকাশকের এই বক্তব্য সমর্থন করতে রাজি নই। কেননা, আমি মনে করি সময়মতো পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত ও জমাপ্রদান করাও লেখকের যোগ্যতার মধ্যে পড়ে। যে লেখক সময় মেনে ও বুঝে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন না, তার বই প্রকাশ না হওয়াই সমীচীন। কাণ্ডজ্ঞানহীন লেখক তাতে রাগ বা গোস্সা যাই করুন, প্রকাশকের এতে কান না দিলেও চলে।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমি ‘জেনারেলাইজ করা’ বা সামান্যিকরণের পক্ষে নই। অর্থাৎ দেশের সকল প্রকাশক একরকম, তা কিন্তু সত্যি নয়। অন্তত গোটা কুড়ি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা কিনা পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতের কাজটি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে দায়িত্ব নিয়ে করছেন। পাণ্ডুলিপি পছন্দ না হলে তা ফেরত দেবার সাহসও তারা দেখান। অনুরুদ্ধ ও নির্দেশিত হয়ে বা শুধু অর্থাগমের বিষয়টি মাথায় রেখে তারা যা-তা ধরনের বই প্রকাশ করেন না। এসকল প্রকাশককে আমি সাধুবাদ জানাই। তাদের প্রতি রইলো অমেয় শ্রদ্ধা। কিন্তু বেশির ভাগ প্রকাশক মনে করেন বইপ্রকাশ নিছক একটি ব্যবসা।

মুরগি ধরার ব্যাপারটা উহ্য রেখেও বলা যায়, এই শ্রেণির প্রকাশক প্রকাশিত বইয়ের মানের বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগী নন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, তারা মনে করেন লেখা মানেই ছাপা, আর ছাপাখানার বদৌলতে খুব সহজেই খেরোখাতা হয়ে যায় বই। তারা নিজেরাও জানেন না, মানহীন অপাঠযোগ্য এসব বই প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকের সঙ্গে তারা কীভাবে প্রতারণা করছেন। বই বিক্রির সংখ্যা ক্রমশ কমে যাবার পেছনে তাদের এহেন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ এবং ‘সকলকে খুশি করার প্রবণতা’ অনেকাংশে দায়ী বলে আমি মনে করি। অবশ্য এক্ষেত্রে দায় কিছুটা লেখকের উপরেও বর্তায়। একজন নবীন লেখক পাণ্ডুলিপি তৈরি করেই প্রকাশকের কাছে গিয়ে ধরনা দেন, এবং বারবার তা প্রকাশের অনুরোধ জানালে একসময় সহৃদয় প্রকাশকের পক্ষে তা প্রত্যাখ্যান করা কঠিন হয়ে পড়ে। মানবতা বলে কথা! এক্ষেত্রে আমার সাফ জবাব, লেখালিখি করতে গেলে ধৈর্য থাকতে হয়, ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ বা নিজেই নিজেকে যাচাই করবার মতোন মানিসক স্থৈর্য্য থাকাটা জরুরি। যার প্রস্তুতি নেই এবং আত্মসম্মানবোধের ব্যাপক ঘাটতি আছে, তিনি কী করে লেখক হবেন! ইদানীং দেখা যায়, একশ্রেণির লেখক তার লেখা গল্প নয়, বরং নিজেকেই বেশি বিক্রি করছেন। তাদের পাঠকের ক্ষেত্রেও বিশেষ লৈঙ্গ্যিক পক্ষপাত লক্ষ্য করা যায়। নারী বা আনাড়ি মহলে তার বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, প্রকাশক তাই তার বই প্রকাশে বেশি উৎসাহী।

অর্থাৎ পরিস্থিতির উত্তরণ চাইলে প্রকাশককে চালুনির ভূমিকা পালন করতে হবে। যাচাই না করে বা পাণ্ডুলিপির মানের ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে কেনো বই তারা প্রকাশ করবেন না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলা একাডেমিও প্রকাশিতব্য বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে তাতে পেশাদারি মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। মুখ চিনে বা দৈবচয়নের ভিত্তিতে মান নির্ধারণ করলে তাতে কাজের কাজ কিছুই হবে না, ঘুরেফিরে সেই অপাঠ্য নিন্মমানের সব বই বাজারে উঠে আসবে।

পাঠক প্রতারিত হবে, তাদের রুচি নষ্ট হবে, আর দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের বাংলা সাহিত্যের বর্ণিল ক্যানভাস। তাই বলি কি, নিছক ছাপাখানার ব্যবসা নয়, আসুন আমরা মানসম্পন্ন বই প্রকাশের দিকে মনোনিবেশ করি। অনস্বীকার্য যে, রুচিশীল পাঠক তৈরিতে লেখক এবং প্রকাশকের ভূমিকা রয়েছে। কেননা, আমাদের খেয়ালি পাঠককুল চিপস-চানাচুর পেলে তুলনামূলক দুষ্পাচ্য অথচ উপাদেয় লেখা পড়তে চান না। তাদের সেই ছোটো ছোটো পংক্তির অতি লঘু শ্রেণির মামুলি গল্প চাই। তারা ক্ল্যাসিক সাহিত্যপাঠে আদৌ উৎসাহী নন। মানোত্তীর্ণ এবং সারগর্ভ বই প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকের রুচি ও মনন গঠন করতে হবে। সেই দুরূহ কাজটি কেবল দায়িত্বশীল লেখক এবং সুবুদ্ধিসম্পন্ন প্রকাশকের যুথবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমেই সম্ভব।

এইচআর/পিআর