মতামত

আমার মাতৃভাষা বাংলা

জ্ঞানতাপস ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘মাতা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি- এই তিনটি প্রত্যেক মানুষের পরম শ্রদ্ধার বস্তু’। এসব মহান কথা আজকাল আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। একুশে ফেব্রুয়ারি মানেই যেন সাদা-কালো পোশাক পরা, গান গাওয়া আর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আনন্দ উৎসব করা। মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা, মাতৃভূমিকে ভালোবাসা, মহান ভাষা শহীদদের অবদানকে স্মরণ করা যেন স্রেফ আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে।

তবে মাতৃভাষা কত মধুর তা অনুভব করি বিদেশে থাকলে। বিশেষ করে যখন আমার বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের কণ্ঠে শুনি সোনার তরী, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, শহীদ সালাম রফিক বরকতের নাম। চীনের ইউননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা বিভাগের শিক্ষক আমি। আমার বিভাগের পয়ত্রিশ চীনা ছাত্রছাত্রী শিখছে বাংলা ভাষা। তারা দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতি ও বাংলাভাষা বিষয়কে ‘মেজর’ নিয়ে স্নাতক পর্যায়ে লেখাপড়া করছে। আমার কাজ শুধু বাংলা ভাষাই নয়, সেইসঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস, অর্থনীতি, সাংবাদিকতা, বাংলাসাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে ওদের শিক্ষা দান।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষার চর্চা রয়েছে। প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাভাষার চর্চাকেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত। বিশ্বের বিভিন্ন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাবিভাগ রয়েছে। সেখানে বিদেশি ছাত্রছাত্রীরা আগ্রহের সঙ্গে বাংলা ভাষা শিখছেন, গবেষণা করছেন। বাংলা শুধু বিশ্বের সপ্তম প্রধান ভাষাই নয় এটি মধুরতম ভাষাও বটে। বাংলা ভাষার শ্রুতি মাধুর্যে মুগ্ধ হয়েছে বিশ্ববাসী। আমার চীনা ছাত্রছাত্রীরা যখন বলে ‘বাংলাভাষা খুব মিষ্টি ভাষা’ তখন মাতৃভাষার সেই শব্দ আমার কানে মধুবর্ষণ করে।

চীনে বাংলাভাষার চর্চা নতুন নয়। রবীন্দ্রনাথের চীন ভ্রমণের পর সেদেশে বাংলাভাষা বিষয়ে পণ্ডিতমহলে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। রবীন্দ্রনাথ চীন ভ্রমণ করেন ১৯২৪ সালের এপ্রিলে। তারপর থেকে চীনে রবীন্দ্রনাথ ক্রমশ জনপ্রিয় হয়েছেন। সমগ্র রবীন্দ্র রচনাবলী বাংলা থেকে চীনাভাষায় অনুবাদ হয়েছে। যে চীনা পণ্ডিতরা রবীন্দ্র চর্চা করছেন তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক দং ইউচেন ও অধ্যাপক পাই খাই ইউয়ান স্বনামখ্যাত।

আমার সাবেক সহকর্মী পাই খাই ইউয়ান শুধু রবীন্দ্র রচনাই নয়, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদদীন, শামসুর রাহমানসহ অনেক বাঙালি লেখকের রচনা চীনাভাষায় অনুবাদ করেছেন। চীন আন্তর্জাতিক বেতারে বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার হচ্ছে ১৯৬৯ সাল থেকে। সেখানকার প্রবীণ নবীন চীনা কর্মীরা সকলেই বাংলা বেশ ভালো জানেন। বাংলা বিভাগের পরিচালক ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দীও বেশ ভালো বাংলা জানেন। বাংলা বিভাগের কর্মীদের মধ্যে অনেকেই বাংলা ভাষা শিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটে। নবীনদের মধ্যে অনেকে শিখেছেন বেইজিংয়ে চীন যোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। সেখানেও ২০১১-১২ সালে আমি একাধিক সেমিস্টারে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছি। বর্তমানে চীনে পাঁচ-ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ রয়েছে। আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ খোলার পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে কেন চীনদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ রয়েছে বা চীনের তরুণ শিক্ষার্থীরা কেন বাংলাভাষা শিখছে। জবাবে বলা যায়, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বা বাঙালির সম্পর্ক তো আজকে নতুন নয়। সেই ফা হিয়েন, হিউয়েন সাং, মীননাথ, কাহ্নপা, অতীশ দীপঙ্করের সময় থেকে চীন ও বাংলার মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চীনের ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বেড়েছে। ইউননান মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগের সেতু হিসেবে কাজ করার লক্ষেই বাংলাভাষা শিখছে।

আমার ছেলেমেয়েদের কাছে যখন আমি বাংলাদেশের সংস্কৃতির কথা বলি, যখন ওদের শোনাই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর জীবনী, বৈষ্ণব পদাবলী, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, জীবনানন্দের কবিতা, চর্যাপদের কথা, তখন ওরা বিষ্ময়ে বিমুগ্ধ হয়। ওদের কাছে রবীন্দ্রনাথ এক রাজপুত্র, নজরুল বিদ্রোহী প্রেমিক আর জীবনানন্দ চিরবিরহী। ওরা বাংলাদেশের প্রকৃতি আর সংস্কৃতির কথা শুনে, চলচ্চিত্র দেখে মুগ্ধ। সুন্দরবন, শ্রীমঙ্গল, কক্সবাজার, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, লালবাগের কেল্লা, কুয়াকাটা, সেন্ট মার্টিনের কথা জেনে তারা এসব দেখতে চায়। ওরা ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে গায়, ‘আমার পরাণ যাহা চায়’, ‘এসো হে বৈশাখ, ‘আলো আমার আলো’, ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর’।

কুনমিং শহরে বাংলাদেশের কনসুলেট রয়েছে। আমাদের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে আমার ছেলেমেয়েরা সেখানে গান, কবিতা পরিবেশন করে। ওরা বাংলাদেশকে ভালোবাসে, ভালোবাসে বাংলাভাষাকে। বিশ্বে বাংলাই একমাত্র ভাষা যার মর্যাদা রক্ষায় প্রাণ দিয়েছে বাংলামায়ের সন্তানরা। কে বলে আমার বর্ণমালা দুঃখিনী?

বাংলার মতো সমৃদ্ধ ইতিহাস, সংগ্রামী ইতিহাস আর কোন ভাষার রয়েছে? যতই শাসকের রাজভাষা হোক সংস্কৃত, ফারসি, ইংরেজি, উর্দু। ব্রাত্যজনের ভাষা, প্রাকৃতজনের ভাষা বাংলাকে কি গণমানুষের কবিরা অমর করে রাখেননি? এ ভূখণ্ডের মানুষ যুগে যুগে বাংলাভাষা রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছে, মুখের ভাষায়, সাহিত্যে ও লোকসাহিত্যে তাকে অমর করে রেখেছে। মাতৃভাষার প্রতি এত ভালোবাসা আর কাদের রয়েছে?

এই ইতিহাসে এবং বাংলাভাষার মধুর ধ্বনিতে চীনা তরুণ তরুণীরাও মুগ্ধ হচ্ছে। সেই সুদূর প্রবাসে আমি যখন ওদের বাংলাভাষায় পাঠ দেই তখন অদ্ভুত ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। মনে হয়, শ্রেণিকক্ষে যেন অদৃশ্য হয়ে উপস্থিত আছেন ভাষা শহীদরা, ভাষা সৈনিকরা। পিতা, পিতামহ আরও দূর পূর্ব প্রজন্মের মানুষদের কণ্ঠে শুনতে পাই পুঁথিপাঠ, মনসার গীত, লক্ষ্মীর পাঁচালী, গাজন, গম্ভীরা, ভেলুয়া, মলুয়ার কাহিনিকাব্য। আমার সুজলা, সুফলা সোনার বাংলার রূপ যখন ওদের তরুণ দৃষ্টিকে মুগ্ধ করে তখন আমিও নিজের চিরচেনা দেশকে দেখি নতুন দর্পণে। শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধের ছবির দিকে তাকিয়ে আমারও চোখ সজল হয়ে ওঠে।

তখনি মনে প্রশ্ন জাগে, একুশে ফেব্রুয়ারি কি আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে কেবল আনুষ্ঠানিকতায় আবদ্ধ হয়ে পড়ছে? মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা, বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ ইতিহাস বিষয়ে সচেতনতা কি সৃষ্টি হচ্ছে? বাংলাভাষার মহান লেখকদের লেখাই বা কতটা পড়ছে নতুন প্রজন্ম? ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ভাষা শহীদ এবং ভাষা সংগ্রামীদের কথা জানাতে হবে নতুন প্রজন্মকে।

মাতৃভাষার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জাগাতে হবে। ভাষা আন্দোলন কেবলমাত্র ১৯৪৮ এ শুরু হয়ে ১৯৫২তে শেষ হয়ে যায়নি। ভাষা আন্দোলন এখনও চলছে। বাংলাভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষা, বাংলাভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, বিদেশে বাংলাভাষার প্রচার এগুলো ভাষা আন্দোলনেরই অংশ। অমর একুশের মহান ভাষাশহীদ ও ভাষাসংগ্রামীদের প্রতি জানাই শ্রদ্ধা আর বাংলা ভাষার প্রতি প্রাণঢালা ভালোবাসা।

লেখক : কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক।

এইচআর/এমকেএইচ