জাতীয়

হাট বসেছে সাধুর ধামে

বিকেল থেকেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। সন্ধ্যার পরেই ঘোর অন্ধকার। অমন বৃষ্টি আর অন্ধকারের মাখামাখিতেই কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া আখড়াবাড়িতে বিষাদের সুর বইছে। কার্তিকের প্রথম দিন। সন্ধ্যার পর মেঘ কেটে গেছে। তবে দিনের বৃষ্টি নাকি কার্তিকের রাতের আঁধারকে ভারি করে তোলে। ঠিক তাই হয়েছে। কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ি থেকে ভেসে আসছে বিষাদের সুর লহরি। এ যেন স্বজন হারানোর বিষাদ। যেন গুরু-ভক্তের বিচ্ছেদ লীলার বিষাদ।শহরের ব্যস্ততম রাস্তা এনএস রোড। শুক্রবার মধ্যরাতেও মহাব্যস্ত। ভ্যান, রিকশা, নছিমন, করিমন আর অটোরিকশায় পুরো রাস্তা ঠাসা। পায়ে হাঁটার মানুষেরও কমতি নেই। এনএস রোড হয়ে বড় বাজার পেরুলেই মোহিনী মিলের সরু রাস্তা। আখড়াবাড়ির রাস্তাও এটি। ভিড়ের কারণে ভ্যান ছাড়তে হলো রেলগেটেই। প্রায় আধামাইল হাঁটতে হয় আখড়াবাড়ি পেতে। মোহিনী মিলের কাছে আসতেই বাতাসে বাঁশের বাঁশির সুর লহরি শোনা গেল। সঙ্গে ঢাকের শব্দও।সুর-শব্দ দুইয়ে মিলে ভাব তরঙ্গে প্রাণ দিল। বাঁশির সুর যেন বলতে চাইছে ‘লালন বলে, লালন বলে’। অমন সুরে সুর মিলাচ্ছে হেঁটে চলা লালন ভক্তরাও। ওরা যেন সবাই দোহারি, যেন সবাই সাধক বনে যেতে চাইছে। নিশানা আখড়াবাড়ি।একশত পঁচিশ বছর আগে এমনি দিনে ধরা থেকে বিদায় নিয়েছিলেন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাউল লালন ফকির। লালনের তিরোধান উপলক্ষে ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে প্রতিবছর আয়োজন করা হয় লালন মেলার। এরই ধারাবাহিকতায় ১ কার্তিক থেকে ৫ কার্তিক পর্যন্ত (১৬ অক্টোবর-২১ অক্টোবর) পাঁচ দিনব্যাপি চলছে লালন মেলা। মেলার প্রথম দিন থেকেই সাধক-বাউলের পদচারণে ভরে ওঠেছে কালীগঙ্গার তীর। কোনো বাধাই পথ রুদ্ধ করতে পারেনি সাধক, আশেকানদের। সকল জরা-জঞ্জাল পায়ে মাড়িয়ে হাজার হাজার সন্ন্যাস-সাধক মিলে এক মহামিলনে রূপ দিয়েছে ছেঁউরিয়ার আখড়াবাড়ি। পুরো আখড়াবাড়িই হয়ে ওঠেছে সাধকের তীর্থস্থান। সাধক মুরাদ ব্যাপারী বলছিলেন, এমন দিনের আয়োজনের কথা। ‘প্রায় পয়ত্রিশ বছর থেকে সাঁইজির ধামে আসি। সাঁইজির ধামে সদাই কিনে মন ভরে না। যতই আসি, তৃষ্ণা ততই বাড়ে। এ তৃষ্ণা মিটাবার নয়।সাঁইজির কালামে (বাণী) মুক্তি মেলে। হিংসা-বিদ্ধেষ ভুলে আত্মাকে শিশু রূপ দিতে সাঁইজিই পথ দেখিয়েছেন। মুক্তির তাড়না অনুভব করে তার দেখানো পথেই হাঁটতে চেষ্টা করছি।    যেন কানার হাটবাজার‘অনুরাগ নইলে কি আর সাধন মেলে....।’লালনের এ বাণীই এবার মেলার মূল প্রতিপাদ্য। লালন সাঁইজি জীবনের শেষবেলা পর্যন্ত অনুরাগ দিয়েই সাধন-ভজন করেছেন। অনুরাগের মধ্য দিয়েই মনের মানুষ খুঁজেছেন সাঁইজি। খুঁজে ফিরেছেন ‘মানুষ রতন’, যাকে কখনও ‘মনের মানুষ’, ‘পড়শী’, ‘অচিন পাখি’ আবার কখনও ‘সহজ মানুষ’ বলে ডেকেছেন  লালন ফকির। লালন ভক্তরাও ‘মনের মানুষ’ খুঁজে ফিরতে দিশেহারা। পরনে সফেদ লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, ফতুয়া আর মাথায় গেরুয়াই সংসার ত্যাগী মানুষগুলোর মনের খবরও বলে দিচ্ছে। আবার কেউ এসেছেন এক কাপড়েই। নারী বসনেও সাদার ছড়াছড়ি। এরা জাতে বিশ্বাসী নয়। সাদায় জাত চেনা যায় না। সাদায় রং থাকে না, হিংসা থাকে না। সাদাতেই কালো দূর হয়।এমনটিই মনে করেন সাধক কোরবান শাহ। তিনিও প্রায় তিন দশক ধরে লালনের ধামে আসেন। বলছিলেন, এমন সাধুসঙ্গ দুনিয়ার আর কোথাও মেলানো ভার। লালন আমাদের পথ দেখিয়েছে। ও পথেই মুক্তি। সমাজে এত হিংসা। কেউ কাউকে চিনি না। অথচ এই মানুষেই খোদার ভর। মানুষ না চিনলে খোদা মিলবে কী করে? তাইতো সাঁইজির কালাম ‘এসব দেখি কানার হাটবাজার’।  কোরবান শাহর মতো হাজারও সাধু-ভক্ত মনের মানুষ খুঁজে ফিরছেন। খুঁজছেন নিজেকে, নিজের আত্মাকে। যে আত্মায় ভর করে আছে পরমাত্মা। পরমাত্মার দর্শন মানেই তো মনের মানুষের সঙ্গে মহামিলন। এমন মিলনের সাধনায় সাধকেরা সর্বহারা। সংসার, সমাজ সব হারিয়ে অন্ধের মতো হাতড়াচ্ছে মনের মানুষের সন্ধানে। এসএসএস/এসকেডি/এএইচ/পিআর

Advertisement