খেলাধুলা

মেহেদি মিরাজের ক্রিকেটার হওয়ার গল্প

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অফস্পিনার এবং টেস্ট অভিষেকে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাজিমাত করা মেহেদি হাসান মিরাজের ক্যারিয়ার শুরুর পেছনে রয়েছে দারুণ এক গল্প। সবার জানা, ঘরের মাঠে বিশ্ব যুব ক্রিকেটে (২০১৬ সালের আসরে) অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে নেতৃত্ব দিয়ে, নিজে ভাল খেলে জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন মিরাজ।

কিন্তু আসল সত্য হলো, তারও বেশ কয়েকবছর আগে কিশোর মিরাজ ক্রিকেটের বড় মঞ্চে পা রাখার স্বপ্ন দেখে রেখেছিলেন। তার ক্রিকেটার হওয়ার গল্প যে আরও আগের, তা কজন জানেন? ২০১০ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সী কিশোর মিরাজ যে দলটির বিপক্ষে প্রিয় জাতীয় দলের খেলা প্রথম মাঠে বসে দেখেছিলেন, সেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই ৬ বছর পর তার টেস্ট অভিষেক হয়েছিল।

বৃহস্পতিবার রাতে ক্রীড়া সাংবাদিক নোমান মোহাম্মদের ইউটিউব লাইভ নট আউট নোমানে কথা বলতে এসে এ গল্পটাই শুনিয়েছেন মিরাজ। গল্পের শুরুতে মিরাজ জানিয়ে দিয়েছেন তার পিতা চাননি তিনি ক্রিকেটার হন।

একটি বিশেষ আসর, তার ফাইনাল এবং সেই আসরের সেরা পারফরমার হবার কারণেই মিরাজের আসলে পরবর্তীতে ক্রিকেটার হওয়া সম্ভব হয়েছে। নচেৎ পিতার কথামতো ক্রিকেট বাদ দিয়ে লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে হতো।

মিরাজের মুখ থেকে শোনা যাক তার ক্রিকেটার হওয়ার গল্প

আমি যখন বয়সে বেশ ছোট, ১৩-১৪ বছর; তখন জাতীয় পর্যায়ের বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্ট খেলি। কিন্তু আমার বাবা খুব একটা উৎসাহি ছিলেন না। ক্রিকেটারদের জীবন সম্পর্কে আসলে তার কোন ধারণা ছিল না। তিনি শঙ্কায় ছিলেন, ছেলে ক্রিকেটার হয়ে কী করবে? তারচেয়ে লেখাপড়া করুক, জীবনের নিশ্চয়তা থাকবে। তিনি ভাবতেন ক্রিকেট এবং ক্রিকেটার তো কোন নিশ্চিত পেশাও নয়।

কিন্তু ২০১০ সালের এক ঘটনায় পাল্টে গেল পুরো দৃশ্যপট। বাংলাদেশের অনূর্ধ-১৪ বিভাগীয় ক্রিকেট চাম্পিয়নশিপই আমার জীবনের গতিপথ বদলে দিলো। আমি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হই, ময়মনসিংহে খেলা হয়েছিল। তখন বোর্ড সভাপতি ছিলেন মোস্তফা কামাল স্যার (বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল)। তিনি ফাইনাল দেখতে গিয়েছিলেন।

আমাদের প্রতিপক্ষ ছিল সিলেট। আমরা আনফরচুনেটলি হেরে যাই। তবে আমি ভাল পারফরম করি। আমাদের তিনটি ছেলেকে পুরষ্কার দেয়া হয়, ২৫ হাজার টাকা দেয়া হয়। ম্যান অফ দ্যা ফাইনাল ও টুর্নামেন্টের সেরা বোলারকেও নগদ ২৫ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হয়। আরও গিয়ার্স দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। এক-দেড় মাস পর মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে আমাদের ডাকা হয়। তখন বাংলাদেশের সঙ্গে ইংল্যান্ডের টেস্ট সিরিজ চলছিল। আমি জীবনের প্রথম যাই মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটে।

তখন আমাদের তিন প্লেয়ার ও তাদের পরিবারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমার বাবা গিয়েছিলেন। আমাদের খুলনার কোচ শেখ সালাউদ্দীন স্যার ও খুলনার ম্যানেজার ডেভিড আঙ্কেলও গিয়েছিলেন। আমার আব্বা তখন ক্রিকেট অত ভাল বুঝতেন না। আর ক্রিকেট খেলার ব্যাপারেও খুব একটা উৎসাহ দিতেন না।

একপর্যায়ে আমাদের ৩ ক্রিকেটারকে প্রেসিডেন্ট বক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার বাবাকে গ্যালারিতে নিয়ে যাওয়া হয়। আব্বা মাঠভর্তি দর্শক, নিয়মশৃঙ্খলা, নানান সিস্টেম, পুলিশ ও নানা নিরাপাত্তা বাহিনীর সম্পৃক্ততা দেখে অভিভূত হয়ে হয়ে পড়েন। তিনি বুঝতে পারেন একজন ক্রিকেটারের জীবন কত সুন্দর ও সফল।

আইসিসির তখনকার প্রেসিডেন্ট ডেভিড মরগ্যান ঐ ম্যাচ দেখতে এসেছিলেন। লাঞ্চের সময় আমাদের মাঠে ডেকে নিয়ে ঐ ২৫ হাজার টাকা আর ক্রিকেট গিয়ার্স দেয়া হলো। আমি পুলকিত হলাম। মাঠে বসে জীবনের প্রথম লাইভ আন্তর্জাতিক ম্যাচ (টেস্ট) দেখা হলো।

তখন আমি প্রত্যেক প্লেয়ারকে মাঠে বসে সামনে থেকে দেখলাম। তার আগে টিভিতে দেখছি। কিন্তু সামনে থেকে মাঠে বসে কখনও দেখা হয়নি। সেদিনই প্রথম দেখলাম সব বড় ভাই ক্রিকেটারদের। খুব ভাল লেগেছিল। আমি এত এক্সাইটডে ছিলাম কী বলবো! যাদের সারাজীবন টিভিতে দেখেছি, তারা সবাই চোখের সামনে মাঠে। একবার মাঠের দিকে তাকাই আর একবার জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখি। কী সুন্দর! মাঠের খেলা মুহূর্তে টিভিতে দেখাচ্ছে, একটা অন্যরকম ভাল লাগা।

আব্বাও ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে আম্মুর সঙ্গে অনেক আলোচনা করলেন। আমাদের আশপাশের সবার সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। বলেছেন, ক্রিকেট খেলাটা অনেক সুন্দর, সাজানো গোছানো। ক্রিকেটারদের জীবনও চমৎকার, অনেক ভাল। ক্রিকেটারদের অনেক সম্মান। তখনই আব্বা উৎসাহী হলেন। আমাকেও ক্রিকেটার হওয়ার ব্যাপারে আগের চেয়ে অনেক উৎসাহ জোগাতে শুরু করলেন, সাহায্যও করলেন আরও বেশি করে।

এরকম দেখতে দেখতে সময় কেটে গেল। নিজে থেকে চিন্তা করলাম। লক্ষ্য নির্ধারণ করলাম, একদিন আমিও খেলব এই মাঠে। ইনশাআল্লাহ আমিও জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করব। যতই কষ্ট হোক, জাতীয় দলে খেলব। আল্লাহর অনেক দয়া ও তার প্রতি পূর্ণ কৃতজ্ঞতা যে, ৬ বছরের মাথায় সেই ইংল্যান্ডের সঙ্গেই আমার অভিষেক।

এআরবি/এসএএস/জেআইএম