মতামত

আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ : সত্যের এপিঠ ওপিঠ

কেমব্রিজ অধ্যাপক ডেভিড এল গসলিন ‘Science and the Indian Tradition: When Einstein met Tagore’ (২০০৭) নামে এক গ্রন্থে জানাচ্ছেন আইনস্টাইনের সাথে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছিল মোট চারবার, যার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে ১৯২৬ সালে জার্মানিতে। দ্বিতীয়বার ১৯৩০ সালের ১৪ জুলাই জার্মানির কাপুথে আইনস্টাইনের নিজের বাড়িতে আর তৃতীয়বার সেখানেই আগস্ট মাসের ১৯ তারিখে এবং চতুর্থ ও সর্বশেষ নিউইয়র্কে ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে। সবাই জানেন ১৯৩০ এর দশকে জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা অতীতের সবাইকে ছাড়িয়ে যায়, এমনকি জার্মানির অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি আর উপন্যাসিক মারিয়া রিলকে-কেও অতিক্রম করেন রবীন্দ্রনাথ। রিলকে-কে বলা হয় জার্মান ভাষার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ লিরিক্যাল পোয়েট।

অন্যদিকে আইনস্টাইনের জনপ্রিয়তা বলতে গেলে অনেকটা স্থান-কালের ঊর্ধ্বে, বিশেষ করে ১৯১৯ সালের ২৯ মের পর পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর অবস্থান হয়ে পড়ে হিমালয়ের সমান যখন সাধারণ আপেক্ষবাদের অনেক ভবিষ্যৎবাণী প্রমাণিত হয় হাতেনাতে। তবে এটা ঠিক, সেই থেকে আজ অবধি সাধারণ মানুষ জানে আইনস্টাইন একটা বিরাট কিছু করেছিলেন, কিন্তু খুব কম মানুষই জানেন তিনি আদতে কী করেছিলেন। কারণ সাধারণ মানুষের চিন্তা যেখানে পৌঁছতে পারে না সেই অভেদ্য সীমানায় আইনস্টাইনের জ্ঞান পৌঁছেছিল। রয়্যাল অ্যাস্ট্রনমিক্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী জে জে টমসন বলেছিলেন, “নিউটনের অভিকর্ষতত্ত্ব আজ থেকে মানুষের চিন্তাজৎ থেকে বিদায় নিল, এটা এক মহাবিপ্লব”।

আশ্চর্যের ব্যাপার গোটা গ্রেটব্রিটেনে রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকলে জার্মানিতে ঠিক তার উল্টোটা ঘটে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট আর ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা যাই হোক না কেন রবীন্দ্রনাথের দর্শন আর তাঁর গভীর অন্তর্দৃষ্টি গোটা জার্মান সমাজকে সে সময়ে বড্ড নাড়া দেয়। অবশ্য এর কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন কান্ট, ফিকটে, শেলিং, হেগেলের মতো জার্মানের বিশ্বসেরা ভাববাদী দর্শনের যে ঐতিহ্য ছিল তার মূলগত বিষয়বস্তু রাবিন্দ্রিক ভাবধারার খুব কাছাকাছি। জার্মান বিখ্যাত ওরিয়েন্টাল দার্শনিক ম্যাক্স মুলার (১৮২৩-১৯০০) সম্ভবত ভারতীয় চিন্তাকে জার্মানবাসীদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। তার থেকেও বড় কথা হলো, প্রাচ্যের যে এসেটিসিজম বা সন্ন্যাসবাদ তার মূল ধারার সাথে জার্মান ভাববাদী দর্শনের কোনো তফাৎ নেই। রবীন্দ্রনাথ সেটা পেয়েছিলেন উপনিষদ থেকে, “ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগৎ্যাং জগৎ/তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ধনম্”(ঈশোপনিষদ্)। পাশ্চাত্যের বহু বক্তৃতায় বিশেষ করে ম্যানচেস্টারে হিবার্ট বক্তৃতামালায় তিনি বারবার উচ্চারণ করেন ঈশ উপনিষদের এই মর্মবাণী।

রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইন ছিলেন প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের অত্যন্ত প্রভাবশালী দুজন মানুষ যারা ১৯১৩ ও ১৯২১ সালে নোবেল পুরষ্কার পান যথাক্রমে সাহিত্য ও পদার্থবিজ্ঞানে। কাজেই তাঁদের মাঝে চিন্তার বিস্তর ফারাক থাকবে এটা নতুন কিছু নয়, কিন্তু নতুন কিছু হলো রবীন্দ্রনাথ যখন বৈজ্ঞানিক সত্য নিয়ে কথা বলেন, আর আইনস্টাইন বলেন সৌন্দর্য, চেতনা, দর্শন আর প্রকৃতি নিয়ে। ঠিক তখন মনে হয় তাঁরা যেন একে অন্যের গভীর সীমানায় প্রবেশ করেছেন অনাহূতের মতো। আদতে তা না, তাঁরা ছিলেন একই সত্যের কেন্দ্রাভিমুখী দুটো ভিন্ন পরিব্রাজক। কাজেই তাঁদের চিন্তার এই পারস্পারিক অতিক্রম্য অংশগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এখানে দেখব তাঁরা সত্য, সুন্দর, চেতনা আর মহাজাগতিক সত্তা নিয়ে কী বলেছিলেন; কী নিয়েই বা তাঁদের মতভেদ হয়েছিল।

এই ঐতিহাসিক কথোপকথনের প্রথম অংশ ১৯৩০ সালের ১০ আগস্ট নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে এবং পরের বছর তা এশিয়া ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। আলোচনা শুরুর সময় আইনস্টাইনের শ্যালক ডিমিট্রি ম্যারিয়েনঅফ তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেবার পর্বে বলেন, ‘তাঁদের দুজনের একসাথে দেখার ব্যাপারটা সত্যিই খুব রোমাঞ্চকর, যেখানে রবীন্দ্রনাথ হচ্ছেন সকল চিন্তার গুরু, আর আইনস্টাইন হলেন যেন সব কবিদের সেরা কবি। কেউ কারও ওপর তাঁর নিজের চিন্তা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে না, কিন্তু একজন ভাষ্যকর উপলব্ধি করতে পারবেন যেন দুটো গ্রহ গভীর তন্ময়তার ভেতর দিয়ে একে অন্যের সাথে কথা বলে চলেছেন।’

আমাদের আজকের আলোচনায় প্রবেশের আগে দুজনের দার্শনিক অবস্থানটা জানা খুব জরুরি, যা এই কথোপকথনের ওপর ভীষণ প্রভাব ফেলেছিল। আইনস্টাইন যেহেতু একজন বিজ্ঞানী তাই তিনি সবসময় খুঁজেছিলেন একটা নৈর্ব্যক্তিক সত্যকে যা স্থান, কাল নিরপেক্ষ এবং কিছুতেই মানুষের মনের ওপর বা ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল না। যাকে আমরা সত্যি বলি সেটা সব অবস্থায়ই সত্যি, মানুষ সেটা উপলব্ধি করুক বা না করুক। আমি না থাকলেও এই জগত থাকবে, থাকবে ফুল পাখি আর সন্ধ্যার সূর্য ডোবার অপরূপ দৃশ্য।

মনের বাইরে সত্যের এই অবস্থান দার্শনিকের ভাষার বলে রিয়েলিজম বা বাস্তববাদ। অর্থাৎ এদিক থেকে আইনস্টাইন ছিলেন জ্ঞানতাত্ত্বিক বাস্তববাদী (epistemological realist)। আমরা সাধারণভাবে বাস্তববাদ বলতে যা বুঝি দর্শনে এর মানেটা একটু অন্যরকম। আমার মনের বাইরে বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্ব থাকতে পারে সেটাই বাস্তববাদ। আমি দেখি না দেখি আমার ঘরে পড়ার টেবিলটা থাকবে, অর্থাৎ পড়ার টেবিলটা আমার দেখার ওপর নির্ভর করে না। আমি দেখি বা না দেখি এমনকি আমি মারা গেলেও টেবিলটা থাকবে, এটাই দার্শনিক বাস্তববাদের মূল বক্তব্য।

মজার ব্যাপার, এদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন পুরোদস্তুর অ্যান্টি-রিয়েলিস্ট। তিনি মনে করেন মনের বাইরে কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব। আমি যদি না থাকি তাহলে সত্য উপলব্ধির কেউ থাকবে না। এ যেন সেই আইরিশ দার্শনিক বিশপ বার্কলির বিখ্যাত উক্তির পুনরুৎপাদন ‘To be is to be perceived’. চুনির লালত্ব আর পান্নার সবুজত্ব সবটুকু নির্ভর করছে আমার চেতনার ওপর। আমি ভালো বলি তাই সে ভালো। কোনো জিনিসকে সুন্দর বললে তার সৌন্দর্য উপলব্ধির জন্য আমার মনটাই প্রধান। তাজমহল সুন্দরও না, অসুন্দরও না। আমি এর ওপর সৌন্দর্য আরোপ করি তাই এটা সুন্দর হয়ে ওঠে। অ্যান্টি-রিয়েলিজম অনেকটা অভিজ্ঞতাবাদের মতো, এই বিশ্বভূমি আমার অভিজ্ঞতার স্মারক। এ যেন দেবর্ষি নারদদের সেই কথা, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান, অয্যোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ (ভাষা ও ছন্দ) আমিই সত্য রচনাকারী, আমার বাইরে সত্য নেই। ‘আমি চোখ মেললুম আকাশে,/ জ্বলে উঠলো আলো/পুবে পশ্চিমে। গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’,। সুন্দর হলো সে’ (আমি)। এহেন অবস্থান কিছুটা কাণ্ডজ্ঞানের পরিপন্থী মনে হবে তবে সকল ভাববাদীর মতো রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন এই বিশ্বজগৎ একটা উদ্দেশ্যমুখী। এর নিরন্তর ছুটে চলার একটা উদ্দেশ্য আছে। এই আমি কিছুতেই বিচ্ছিন্ন কেও নয়, এটা সর্বতাংশে সেই অনন্ত-চির আমির খণ্ডিত অংশ। সে আমার ভেতর দিয়েই সত্য হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে মূর্ত।

শুরুতেই আইনস্টাইন প্রশ্ন করলেন, বিশ্বাতিরিক্ত কোনো অলৌকিক ও চূড়ান্ত সত্তায় তিনি বিশ্বাস করেন কিনা। রবীন্দ্রনাথ উত্তর দেন, এটা বিশ্বাতিরিক্ত নয়, এক অসীম সত্তা সব কিছুর অন্তর্গত, কিন্তু তার এই অসীমের প্রকাশ ব্যক্তিক সত্তার মধ্য দিয়ে। কাজেই এই মহাজগতের সত্য মানেই সেটা ব্যক্তিক সত্যের সসীম রূপ। এটা বোঝাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানের একটা উদাহরণ দেন। পদার্থ প্রোটন আর ইলেকট্রন দিয়ে গঠিত কিন্তু তাদের অভ্যন্তরে থাকে ফাঁক, যদিও ওপর থেকে দেখলে দেখা যায় একটা অখণ্ড বস্তু। একই রকমভাবে সমগ্র মানবসত্তা গঠিত হয় ক্ষুদ্র ব্যক্তিক সত্তার সমন্বয়ে। কাজেই এটা আমাদের গ্রহণ করতে হবে যে বিশ্বসত্তার প্রকাশ ঘটেছে ব্যক্তিক সত্তার অবভাসের মধ্য দিয়ে। তাই তিনি বলেন, তাঁর সাহিত্য এবং সমস্ত চেতনার ভেতরেই এই সত্য প্রকাশিত হয়েছে নিরন্তর। যখন সেই পরম সত্তার সাথে বিশ্ববীণার তারে একই সুর বেজে ওঠে তখন প্রকাশিত হয় সত্য। আর যেটা সত্য সেটাই সুন্দর। কিটস যেমন Ode on a Grecian Urn কবিতায় বলছেন, ‘Beauty is truth; truth beauty; --that is all Ye know on earth, and all ye need to know’.

এর প্রেক্ষিতে আইনস্টাইন বলেন, তাহলে দুটো জিনিস আমরা পরিষ্কার, প্রথমত, এই বিশ্বজগৎ আমাদের চেতনার ওপর নির্ভরশীল, আর অন্যটা হলো, এর মানবচিন্তার বাইরে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা। আইনস্টাইন প্রশ্ন করেন, তাহলে কি আপনি মনে করেন মানুষ যদি এই পৃথিবীতে না থাকে তাহলে Apollo of Belvedere এর সৌন্দর্য থাকবে না? Apollo of Belvedere হলো ভাটিক্যান সিটিতে ভাটিক্যান মিউজিয়ামে রাখা মার্বেলের তৈরি অপূর্ব এক মূর্তি। খ্রিস্টপূর্ব ১১৭ থেকে ১৩৮ অব্দের মধ্যে এটা তৈরি করা হয়। রবীন্দ্রনাথ সাথে সাথে বলেন, ‘থাকবে না’। তাঁর যুক্তি হলো মানুষই যদি না থাকে তাহলে সৌন্দর্য উপলব্ধি করবে কে? সৌন্দর্য নিয়ে এই বক্তব্য আইনস্টাইন কিছুটা মেনে নিলেও সত্য নিয়ে তাঁর এই বক্তব্য কিছুতেই গ্রহণ করতে পারেননি। ত্রিভুজের তিন কোণ মিলে দুই সমকোণের সমান হবে, এই উপপাদ্য কি মানুষ না থাকলেও সত্য হবে না? এ প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ ফিরে যান, ভারতীয় চিন্তার অন্যতম আধার উপনিষদের কাছে। সত্যকে তিনি ভাগ করতে চান দুভাবে। একটা আপাত বা দৃশ্যমান উপলব্ধি যাকে সত্য বলে মনে হয়; আর অন্যটা হলো পরম সত্য। আপাত সত্যকে তিনি মায়া বা অধ্যাস হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু পরম সত্য তো নিত্য, অনন্ত আর অক্ষয়।

আদতে রবীন্দ্রনাথ পরম সত্য সম্পর্কে যা বলতে চেয়েছেন তার ইঙ্গিত আমরা পেয়েছি তাঁর বিপুল কাব্যসম্ভারে। তিনি বিশ্বাস করেছেন এক চরম ও পরম সত্য, যা মহাজগৎব্যাপী নিত্য, আর বিস্তৃত অনন্তের আধার। তাঁর প্রকাশ এই আমাকে ঘিরে। ‘সদা জননাং সন্নিবিষ্ট’ আমাদের হৃদয়ে যিনি সর্বদা বিরাজিত, তিনিই পরম আত্মা, তিনি জগদ্ব্যাপী ও কিছুতেই হনন যোগ্য নয়, ‘ন হন্যতে হন্য মানে শরীরে’। তবে রবীন্দ্রনাথ আইনস্টাইনের দিকে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেন, যখন বলেন, ‘বস্তু বলতে আমরা কী বুঝি’? যেটাকে আমরা বস্তু বলি সেটা কি চূড়ান্তভাবে ঘূর্ণায়মান বৈদ্যুতিক তরঙ্গ নয়? ইলেকট্রন প্রোটনের নিত্য চলাচলে সব বস্তুসকলই তো আমাদের কাছে হাজির হয়। কাজেই ধরে নিতে হবে আমরা যাকে বস্তু বলছি সেটা সবক্ষেত্রে কিছু দৃশ্যমান ঘটনার একক সমাবেশ। তাই সবসময় মনে রাখতে হবে, ব্যক্তিক সত্তার সাথে বিশ্বসত্তার চলছে এক নিরন্তর সংঘাত। আর এই দুই সত্তার মাঝে সমন্বয় ঘটানোই আমাদের বিজ্ঞান, দর্শন আর নীতি চিন্তার মুখ্য উদ্দেশ্য।

আইনস্টাইন প্রাচ্যের এই দুর্বোধ্য ব্যাখ্যায় কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি প্রশ্ন করেন, কোনো বস্তুকে আমি না দেখলে সে যে থাকবে না সেটা কোনো বৈধ যুক্তি হতে পারে না। বার্কলি যেমনটা এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, আমি টেবিলটা না দেখলেও এক সর্বজ্ঞ সত্তা সেটাকে সবসময় নজরে রাখেন। রবীন্দ্রনাথ সেই উত্তরই দিলেন। কিন্তু আইনস্টাইন বলেন, আমরা যে আমাদের চিন্তার বাইরে একটা অতি-মানবিক সত্তার ওপর সত্য আরোপ করছি সেটা দিয়ে আদতে আমরা কী বোঝাচ্ছি তা আমাদের কাছে ভীষণ অস্পষ্ট।

প্রথম সাক্ষাতের পর আগস্ট মাসের ১৯ তারিখ দ্বিতীয়বার আবার তাঁরা আবার মিলিত হন। দ্বিতীয়বারের মুখ্য বিষয় ছিল, মানবচিন্তার বাইরে স্বাধীনভাবে জগতের অস্তিত্বের সম্ভাবনা নিয়ে। আর সেখানে মুখ্যত কোনো বিতর্কে তাঁরা না জড়িয়ে ভারতীয় সঙ্গীত আর পাশ্চাত্যের সঙ্গীতের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করেন। আর এই আলোচনাজুড়েও থাকে সেই তাদের সূক্ষ্ম মতপার্থক্য। প্রথমেই তাঁরা শুরু করেন আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ধারা কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অনিশ্চয়তা প্রসঙ্গে (যদিও তারা সরাসরি সেটা উল্লেখ করেননি)। রবীন্দ্রনাথ অনিশ্চয়তা নীতির বিষয়টা তুলে আনেন, আইনস্টাইন স্বভাবতই এতে অস্বস্তি প্রকাশ করে বলেন, পদার্থের অতিক্ষুদ্র এলাকাতে যে অনিশ্চয়তা আছে বলে কোয়ান্টাম বাস্তবতায় প্রকাশ করা হয় তারও কিন্তু একটা গভীর সুস্থিত বাস্তবতা আছে।

উল্লেখ্য আইনস্টাইন কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে বিশেষ করে নিলস বোরের অ্যান্টি-রিয়েলিজম বাস্তবতাকে গ্রহণ করেননি। বোরের সাথে ভীষণ বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন আইনস্টাইন। কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশন পর্যন্ত গড়ায় এ বিতর্ক। আমাদের অভিজ্ঞতায় যেহেতু পদার্থের ক্ষুদ্রতম এলাকাতে অনিশ্চয়তা ধরা পড়ে তাই অভিজ্ঞতাকে কিছুতেই অগ্রাহ্য করা যায় না। তবে আইনস্টাইনের অভিমত হচ্ছে, যদিও মনে হয় সেখানে কোনো সুশৃঙ্খলতা নেই, তবু গভীরভাবে দেখলে বোঝা যাবে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে আমরা এই নিয়ম দেখতে পাই কিন্তু খুব গভীরে সেটা দৃষ্টিগোচর হয় না। দৃষ্টিগোচর হয় বিশৃঙ্খলতা আর বিভ্রান্তির। যেমন দূর থেকে আমরা যখন মেঘ দেখি তখন সেটা একক কিছু মনে হয় কিন্তু খুব কাছে এলে ধরা পড়ে সেগুলো কতো বিশৃঙ্খল জলকণা!

আইনস্টাইন বলতেন, যদি তিনি পদার্থবিজ্ঞানী না হতেন তাহলে একজন বেহালাবাদক হিসেবে সারাজীবন সাধনা করতেন। সুর, তাল আর শিল্পভাবনার বিষয়গুলো বারংবার তাদের আলোচনায় চলে আসে। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তাঁরা দুজনেই শেষ পর্যায়ে আমাদের অভিজ্ঞতার জগতের সীমাবদ্ধতা নিয়ে শেষ করেন। আইনস্টাইন বলেন, আমরা কোনো বিষয় নিয়ে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করি তা মৌলিকভাবে ভিন্নতর হতে পারে। সেটা প্রাচ্য বা প্রতীচ্যের আর্টের ওপর আমাদের প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রেও হতে পারে। রবীন্দ্রনাথকে তিনি এ সময় বলেন, আমরা যদি একটা লাল গোলাপ টেবিলের ওপর আমাদের দুজনের সামনে রাখি তাহলে আমাদের নিশ্চয় দুজনের একরকম প্রতিক্রিয়া হবে। এই ভিন্নতা দৃষ্টির, ভিন্নতা চেতনার আর দার্শনিক বোধের। তাই সত্য নিয়ে দুজন দার্শনিকের ভিন্ন প্রতিক্রিয়া ভীষণ স্বাভাবিক।

[এই কথোপকথন নিয়ে দুজনের যে খুব তৃপ্তি হয়, সেটা বলা যাবে না। কারণ রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের ভাষায় সেটা প্রকাশ করতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ বলেন ইংরেজিতে আর আইনস্টাইন বলেন জার্মান ভাষায় যা পরে অনুবাদ করা হয়।]

লেখক : অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/বিএ/এমএস