মতামত

সামাজিক শৃঙ্খলা, সম্প্রীতি ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজ

মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্যের প্রতীক ও ঐতিহ্যবাহী সম্মিলন হলো হজ। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ এড়াতে এবছর খুবই সীমিত পরিসরে হজের অনুমতি দিয়েছে সৌদি আরব। দেশটির মাত্র দশ হাজার জন এবারের হজে অংশ নিতে পারবেন। এই প্রথমবারের মতো বিদেশি মুসলিমদের জন্য হজ নিষিদ্ধ করেছে সৌদি। হজ চলাকালীন কাবা শরিফ স্পর্শ করা যাবে না। অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের সময় যেমন-নামাজ ও কাবা শরিফ তাওয়াফ করার সময় সামাজিক দূরত্ব (এক হাজি থেকে আরেক হাজির মধ্যকার দূরত্ব দেড় মিটার হবে) বজায় রাখতে হবে। সীমিত সংখ্যক হাজি মিনা, মুজদালিফা ও আরাফাতে যাওয়ার অনুমতি পাবেন।

মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ এবং আত্মনিবেদনের ধ্বনি ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’- উচ্চারণের মধ্যদিয়ে বিশ্ব মুসলিমের মহাসম্মিলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। হজে অংশ নেয়া মুসলমান আরাফাতের ময়দানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের উদ্দেশে বলছেন- ‘হে আল্লাহ বান্দা হাজির, আপনার দরবারে হাজির, হে লা শরিক আল্লাহ, আমরা হাজির আপনার দরবারে। সকল প্রশংসা, সকল ক্ষমতা ও প্রভুত্বের মালিক একমাত্র আপনি।’ হজ ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ ও মৌলিক ইবাদত। প্রকৃত জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন প্রত্যেক সচ্ছল মুসলিম নর-নারীর ওপর হজ ফরজ। আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, `মানুষের মধ্যে যারা পথের ব্যয় নির্বাহ করতে সক্ষম তাদের ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কাবাঘরে হজ পালন করা ফরজ`। আত্মিক উন্নতি, সমাজে একে-অন্যের সঙ্গে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, সামাজিক শৃঙ্খলা, সম্প্রীতি ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় হজের গুরুত্ব অত্যন্ত ব্যাপক। কেননা এ হজই হলো সেই পন্থা যেখানে সারা বিশ্বের মুসলমানরা একে-অন্যের সান্নিধ্য লাভ করতে পারে। তাই মুসলিম বিশ্বের ঐক্য গড়তে হজের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

হজকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারলে ও এর মাহাত্ম্য যদি সঠিকভাবে আমল করা যায় তবে শান্তির পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। হজ পালন করতে গিয়ে মুসলমানদের সঠিক দিকনির্দেশনাও লাভ করা যায়। হজ শুধু আনুষ্ঠানিকতায়ই সীমাবদ্ধ নয়, বরং নিজেকে সংশোধনের এক ফলপ্রসূ পদ্ধতি, যার ফলে মুসলমানদের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করা সম্ভব। হজের অন্যতম ফরজ কাজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান, যার প্রধান উদ্দেশ্য সমবেত বিশ্বমুসলিমের করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে বিশ্বনেতাদের দিকনির্দেশনা প্রদান।

মহানবী (সা.)-এর হজ থেকে এ শিক্ষাই পাওয়া যায়। তিনি বিদায় হজের সময় আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত মুসলিমদের উদ্দেশে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিকসহ বিভিন্ন বিষয়ের দিকনির্দেশনা দিয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন এবং তার বক্তব্য অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছানোরও নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ভাষণই বিদায় হজের ভাষণ নামে পরিচিত। পবিত্র কাবাঘর প্রদক্ষিণ, আরাফাত ময়দানে অবস্থান, সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যে দৌড়ানো, জামারায় পাথর নিক্ষেপ, আল্লাহর উদ্দেশে পশু কোরবানি ইত্যাদি হজের আনুষ্ঠানিক ইবাদত।

হজের এসব ইবাদত প্রতিটি প্রতিটির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং প্রতিটি ইবাদতের রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও নিজস্ব ঐতিহ্য। প্রকৃতপক্ষে হজ বিশ্বমুসলিমের এমন এক সম্মিলন, যা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং জাগতিকভাবে করে সুশৃঙ্খলিত। এর মাধ্যমে শান্তির এক স্রোতধারা সৃষ্টি হয়। হজের মাধ্যমে বিশ্বমুসলিমের আধ্যাত্মিক-নৈতিক উন্নতি এবং সম্প্রীতির এক অনন্য বন্ধন তৈরি হোক, বৃদ্ধি পাক সামাজিক সংহতি এবং মানুষের প্রতি মানুষের অপরিসীম শ্রদ্ধা।

হজের মাধ্যমে অর্জিত পরিশুদ্ধতার অন্তর্নিহিত চেতনা প্রকৃত অর্থে কাজে লাগানো সম্ভব হলে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সংহতি দৃঢ় করার প্রক্রিয়া সহজতর হবে। মুসলিম বিশ্বের এই ক্রান্তিকালে হজের প্রেরণা ও বিদায় হজের ঐতিহাসিক শিক্ষা বিশ্ব মুসলিমের উত্তরণের সবচেয়ে কার্যকর পাথেয় হতে পারে।

এইচআর/এমকেএইচ