প্রবাস

ঘুরে এলাম স্বপ্নের শহর ভেনিস

পায়েল আসাদ, ইতালি থেকে

রোমান্টিক শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম ইতালির ভেনিস। ভেনাস আর ভেনিসের মাঝে আমি কেন যেন অনেকটা মিল খুঁজে পাই। ভেনাসকে যেমন ভালোবাসা, শিল্পের, শান্তি, সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়, ঠিক তেমনি ভেনিসেও ঐতিহ্য, শিল্প, সৌন্দর্যে ভরপুর।

দূর থেকে সবুজ-নীলচে পানি, তার উপর ভাসমান বাড়ি সঙ্গে মৃদু হাওয়ায় যেন শান্তির সঙ্গে একচিলতে সুখ মিশে আছে। ভেনাসের সঙ্গে আর একটা সম্পর্ক রয়েছে ভেনিসের। ভেনাস ছাড়াও আরও পাঁচটি গ্রহ ও প্রায়ই দেখা যায় ভেনিসের আকাশে।

পৃথিবীর বুকে ভেনিস এমন একটি জায়গা যেখানে সাগর, আকাশ, ভূমি, বাস্তবতা এক হয়ে জীবন্ত দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে সাগরের জল, জলে আকাশের ছায়া, দূরে জলের সাথে আকাশের মিলন, জলের ওপর বাড়ি, পানি আর পাথরের সরুপথ, পথে দিনের ব্যস্ততা।

রোম থেকে ভেনিস আনুমানিক প্রায় ৬৫৫ কিমি। যা পাড়ি দিতে আমাদের প্রায় ৮-৯ ঘণ্টার সফর করতে হয়েছে বাসে। কিন্তু পরিবারের পিকনিকে সফর আর সফরের মতো তো লাগেই না। দুষ্টামি, মজা আর গল্প করতে করতে ঘুমানোরই সময় পাওয়ায়ই কষ্টের হয়ে যায়।

আমরা ৮ জন যার মধ্যে ৩ জন ১২ বছরের নিচে। যেখানে বাচ্চাগুলার চিল্লাচিল্লি আর দুষ্টামি করার কথা আমরা বড়রা ওদের থেকে এক কদম এগিয়ে ছিলাম। বাস এর সবার হয়তো একটু হিংসা হচ্ছিল আমাদের মজা করতে দেখে কিন্তু তারপর তাদের স্থান হলো ঘুমের রাজ্যে।

ভেনিস দেখার বা চলাচলের দুটি যান আছে ওয়াটার বাস আর দুই পা। ভেনিস ঢোকার পরপরই গাড়ির রাস্তা শেষ। ভেনিস ঢোকার পর আমাদের যাত্রার মূল লক্ষ্য ছিল পিয়াজ্জা সান মার্কো। যাকে কিনা ইউরোপের ড্রয়িংরুম বলা হয়। পিয়াজ্জা সান মার্কোতে কয়েকটা জাদুঘর, বড় চার্চ, শান্তির প্রতীকী করা টাওয়ারসহ হাজারও কবুতরের আনাগোনা রয়েছে।

ভেনিসের কাঁচের ব্রিজ থেকে সান মার্কো এতদূর হতে পারে ভাবতে গেলে এখন পা ব্যথা করে। অনেক দূর হাঁটার পর যখন মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম, মামা আর কতো দূর?

মামা বললেন, বেশি দূর না ওই যে গাছ। গাছের ওপারেই।

কিন্তু যাওয়ার পথে ওই রকম যে কতগুলো গাছ আর ওই রকম কত ব্রিজ পার হয়েছি তার হিসাব নাই। রাস্তায় প্রায় দোকানিগুলোই ভেনিসের ঐতিহ্যবাহী কার্নিভালের কাপড়, মাস্ক এবং আরও বিভিন্ন জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছে।

ব্রিজের পর ব্রিজ, নৌকা ভ্রমণ, হাঁটাহাঁটি করতে করতে অবশেষে সান মার্কোতে পৌঁছালাম। অসম্ভব সুন্দর একটা জায়গা সাথে অনেকগুলো কবুতর। কিন্তু অবাক করার বিষয় কবুতরগুলো মানুষ দেখে মোটেও বিব্রত বা ভীত না। সবাই কবুতরকে খাওয়াতে ব্যস্ত। কবুতরগুলোও সাদরে ভোজন গ্রহণ করে মানুষের হাতে আর মাথায় উঠে নাচছে।

আমার ছোট মামাতো বোন কবুতরকে মাথায় বসানোর জন্য মাথায় পপকর্নের গোসল পর্যন্ত সেরে ফেললো। অবশেষে ওর মাথায় হাতে কবুতরের এমন হাট বসলো।

এরই মধ্যে সবার পেটের ইঁদুরগুলো দৌড়াদৌড়ী শুরু করে দিলো। তাই সবাই খাবার দোকানে হানা দিলাম। কিন্তু বাহিরে এত সুন্দর দৃশ্য রেখে ভেতরে খাওয়া নির্ঘাত বেকুবি। আমাদের সবার আগেই খালামনি খুব সুন্দর একটা জায়গা আবিষ্কার করল।

সরু একটা পানি পথের পাশে কাঠের পুল বানানো হয়েছে। পা পানিতে আঁধো ডুবিয়ে আমরা খাওয়া শুরু করলাম। জায়গাটা অনেকটা নিরিবিলি। কিছুক্ষণ পরপরই কয়েকটা করে গন্ডোলা (ভেনিসের ঐতিহ্যবাহী নৌকা) যাচ্ছিল।

গন্ডোলার কিছু বৈশিষ্টের কারণে এটি ভেনিসের পানি পথের মধ্যে জনপ্রিয় আর ঐতিহ্যবাহীর স্থান যখন করে আছে। গন্ডোলা ৮টি কাঠের মিশ্রনে বানানো সরু নৌকা। এটি খুব দ্রুত দিক পরিবর্তন করতে পারে। খুব দ্রুত থামানোর সুবিধা, দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য সামনে দাঁত আকারের কিছু একটা আছে।

আমি ক্ষুধায় পুরোই খাওয়ার মাঝে মনোযোগী ছিলাম। এরই মধ্যে মামা বললো, তোমার মনে হয় না আমাদের দলে মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে?

প্রথমতো প্রশ্নটা আমি বুঝিনি তাই খাবার থেকে মুখ উঠিয়ে মামার দিকে তাকিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম আমাদের পাশের জায়গাগুলো একজন একজন করে ২-৩টা পরিবার বসে পড়েছে। সবাই আবার খাবারের দিকে মনোযোগ দিলাম।

বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হতে শুরু করলো। সন্ধ্যার ভেনিস অন্যরকম সুন্দর। লালচে হলুদ আকাশের ছায়া পানিতে পড়েছে। সবকিছু সোনালী বর্ণ ধারণ করেছে।

কিন্তু আমাদের আর সৌভাগ্য হলো না সোনালী রাজ্যে চোখ ধাঁধানোর। কিছুক্ষণের ভেতরই রওনা দিতে হলো। অনেক কিছুই মিস করেছি, অনেক কিছুই দেখার বাকি ছিল কিন্তু ভেনিস দেখা হয়েছে দিন শেষে সেটাই বড় প্রাপ্তি।

এমআরএম/পিআর