মহান মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের গৌরবময় ভূমিকার কথা সবারই জানা। যুদ্ধে বেসামরিক জনগণেরও রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও অপরিমেয় অবদান। তবে কোনো কোনো জায়গায় আমজনতার বীরত্বগাঁথা ও আত্মত্যাগের কথা হারিয়ে গেছে উদাসীনতায়। চট্টগ্রাম শহরের ‘কাকলী’ নামের বাড়িটির অবস্থাও তেমন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এ বাড়িটি ঘিরে রচিত হয়েছিল এক মহাকাব্যিক উপাখ্যান। বাড়িটির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নৌ-সেক্টর পরিচালিত ঐতিহাসিক গেরিলা অভিযান ‘অপারেশন জ্যাকপট’সহ অজস্র বীরত্বগাঁথা। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই বাড়িটির শেষ চিহ্নটুকুও হারিয়ে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানান বই, সাময়িকী ও প্রবন্ধে ‘কাকলী’র কথা বারবার এলেও কোথাও পূর্ণাঙ্গ কোনো বিবরণ পাওয়া যায়নি। ১৯৯৩ সালে সাহিত্যপ্রকাশ থেকে একটি বই প্রকাশিত হয়। ওই বাড়ির মালিক এনায়েত মওলার লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন ছবি: চট্টগ্রামের কাকলী’ শিরোনামে স্মৃতিচারণমূলক বইয়ে কিছুটা বিবরণ পাওয়া যায় সেই অবিশ্বাস্য ও মহাকাব্যিক আখ্যানের।
‘কাকলী’ নামের বাড়িটিএনায়েত মওলা (জন্ম. ১৯২৯) ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারত থেকে ঢাকায় এসে প্রথমে রেডিও পাকিস্তানে এবং পরে চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। ষাটের দশকের শেষ দিকে চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ এলাকায় একটি বাড়ি নির্মাণ করেন তিনি (যা বর্তমান নগরীর জিইসি মোড়ের কাছাকাছি)। নাম রাখেন ‘কাকলী’।
কয়েক বছর আগেও ওআইএমসিএ নামে একটি বিদ্যালয় পরিচালিত হতো দোতলা ওই ভবনটিতে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য বারবার দাবি উঠলেও অজ্ঞাত কারণে তা করেনি স্বাধীনতার পরবর্তী কোনো সরকারই। বর্তমানে এরিয়াল প্রোপার্টিজ নামে একটি ডেভেপলপার প্রতিষ্ঠান ১৬তলা ভবন তৈরির কাজ করছে এখানে।
এরই মধ্যে ‘কাকলী’র মূল ভবনটি গুঁড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বাঙালি জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধের দীপ্তিমান একটি স্মৃতি। অথচ মুক্তিদ্ধের নয় মাসে চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ছোটখাটো, প্রায় অঘোষিত নিয়ন্ত্রণকক্ষের ভূমিকা পালন করা এই বাড়ি ঘিরে সংঘটিত হয় নানা নাটকীয় আর রুদ্ধশ্বাস ঘটনা।
‘কাকলী’ ও মুক্তিযুদ্ধ‘কাকলী’র মালিক এনায়েত মওলা ছিলেন একজন শখের শিকারী, সেই সুবাদে বন্দুকচালনায় ছিলেন বিশেষ পারঙ্গম। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে একদিন স্থানীয় (নাসিরাবাদ এলাকার) কয়েকজন তরুণ কিছু বন্দুক যোগাড় করে তার বাড়িতে এসে হাজির। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে তারা বন্দুক চালনা শিখতে চান। কিন্তু বন্দুক চালাতে গিয়ে গলদঘর্ম হন তারা। পরে কার কাছ থেকে যেন খবর পেয়ে এই সৌখিন শিকারীর কাছে ছুটে আসেন বন্দুক চালানোর দীক্ষা নিতে।
এনায়েত মওলা প্রথম পর্যায়ে শহরের অদূরে কুমিরার দুর্গম অরণ্যে অস্ত্রচালনা শেখাতে শুরু করেন। পরে ‘কাকলী’র পেছনে নাসিরাবাদের পাহাড়ে (বর্তমান জাকির হোসেন রোডের পাশের পাহাড় বা নাসিরাবাদ আবাসিক এলাকা) নিয়মিত চলে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রচালনা শিক্ষা। এসময় বিভিন্ন স্থান থেকে অস্ত্র যোগাড় করে এনে কাকলীতে রাখা হতো।
এরপর থেকে এলাকার তরুণ-যুবা-পেশাজীবীসহ নারীরাও ‘কাকলী’তে আসতেন অস্ত্র চালনা শিখতে। এসময় এনায়েত মওলা নিজের ছেলেদের এবং তার স্ত্রী আতিয়া নারীদের অস্ত্র চালনা শেখাতেন। এ কারণে তিনি সবার কাছে খালু বলে পরিচিত হন। এনায়েত মওলার অস্ত্র প্রশিক্ষণে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের অংশগ্রহণের বিষয়ে তিনি তার ‘মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন ছবি: চট্টগ্রামের কাকলী’ বইয়ে লিখেছেন, “দলে দলে লোক আসছে। প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আবার চলে যাচ্ছে। মহিলাদের ভিড় বেড়ে যাওয়ায় তাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন আমার বেগম সাহেবা। ...একদিন আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর স্ত্রীও এলেন গুলি ছুড়তে। আর খবরের কাগজে তার ছবিও ছাপা হলো (১৬ পৃ:)।”
চট্টগ্রাম, মোংলা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ বন্দরে একযোগে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ চালান নৌ কমান্ডোরা
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক ড. শামসুল ইসলাম সাইদ তার ‘মুক্তিযুদ্ধের মুখ চট্টগ্রাম’ বইয়ে লিখেছেন, ‘মি. মওলা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে “খালু” নামে পরিচিত ছিলেন। তার বাড়ি “কাকলী” ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় ধরনের ক্যাম্প। মওলা সাহেব পুরুষদের এবং তার স্ত্রী মিসেস আতিয়া নারীদের অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ দিতেন।’
তরুণ যোদ্ধাদের অস্ত্রচালনা শিক্ষা দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে এনায়েত মওলা নিজেই এই ন্যায়যুদ্ধের সঙ্গে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যান। মুক্তিকামী বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নখানি তার চেতনায়ও ঢেউ তুললো প্রবল আবেগে। এরই ধারাবাহিকতায় শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে তার বসতবাড়ি ‘কাকলী’ হয়ে ওঠে একাধারে একটি ছোটখাটো অস্ত্রাগার, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্প ও যুদ্ধ পরিচালনার মন্ত্রণাকক্ষ বিশেষ।
মার্চের মাঝামাঝি সময়ে দেশে পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে উঠে। এ সময় ‘কাকলী’তে অস্ত্র প্রশিক্ষণ বন্ধ হয়ে যায়। খালি হয়ে যায় অস্ত্রাগারও। এর পর থেকে খুব তাড়াতাড়ি দেশের পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। এরই মধ্যে শহরের পাহাড়তলীতে ২৩ মার্চ বিহারীরা বাঙালিদের ওপর চালায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ। এর পরপরই ‘কাকলী’ আবার সরব হয়ে ওঠে বিহারীদের রুখতে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরু হলেও চট্টগ্রাম শহরের চারপাশে বাঙালিদের শক্ত প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি হানাদাররা শহরে খুব সহজে ঢুকতে পারেনি। ২৯ মার্চ দামপাড়া পুলিশ লাইন দখল করে নেয় হানাদাররা। সে দৃশ্য ‘কাকলী’ থেকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করেন এনায়েত মওলা।
তার বইয়ে দেয়া তথ্য ও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, তখন নাসিরাবাদ এলাকা ও বর্তমান জিইসি এলাকায় ‘কাকলী’ ছাড়া মাত্র দু’একটি বসতঘর ঘর ছিল, বড় রাস্তায় (ওআর নিজাম রোড) তখন ইট বসেছে মাত্র। জিইসি মোড়ের বর্তমান যে সেন্টার প্লাজা, তা ছিল একটি খালি জায়গা। তাই ‘কাকলী’ থেকে পুলিশ লাইনে হানাদার বাহিনীর নির্মমতা দেখতে পেতেন এনায়েত মওলা।
এরপর আর ‘কাকলী’তে থাকা উচিত মনে না করায় তিনি পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে যান। একদিন পর ১ এপ্রিল বাড়িটিতে ঘটে হৃদয়বিদারক ঘটনা। ‘কাকলী’তে থাকা মালপত্র আনার জন্য এনায়েত মওলার গৃহকর্মী হাবিব, হাবিবের ভাই মোখলেস, সঙ্গী শহীদুল্লাহ, ‘কাকলী’র চৌকিদার আলীসহ পাঁচজন সেদিন ‘কাকলী’তে ফিরে আসেন।
এখানে ‘কাকলী’ নামে যে বাড়িটি ছিল, সেখানে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা
কিন্তু প্রবর্তক পাহাড়ে টহলরত পাক সেনারা বিষয়টি খেয়াল করে ফেলে। ইতোমধ্যে স্থানীয় রাজাকার ও বিহারীদের কাছ থেকে তারা তথ্য পায়, ‘কাকলী’ থেকেই নাসিরাবাদ এলাকার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এবং অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তাই হাবিবরা ‘কাকলী’তে ঢুকতেই হানাদাররা বাড়িটিতে হামলে পড়ে। ভাঙচুর-লুটপাটের পর হাবিব-আলীসহ পাঁচজনকে ধরে নিয়ে যায় তারা।
পরে বর্তমান সেন্টার প্লাজা’র সামনে ওই পাঁচজনসহ মোট ২২ জনকে একসঙ্গে নির্মমভাবে গুলি করে হানাদাররা। শহীদ হন ২১ জন। পাঁচ-পাঁচটি গুলি খেয়েও বেঁচে যান আলী। এরপর এনায়েত মওলা আর ‘কাকলী’তে না ফিরলেও এলাকার মানুষেরাই বাড়িটি পাহারার ব্যবস্থা করেন। মাসখানেক পর থেকে ‘কাকলী’র কেয়ারটেকার তাহের ও আলী আবারও থাকতে শুরু করেন বাড়িটিতে।
জুন মাসে এনায়েত মওলাকে আবারও খুঁজে বের করে ফেলেন নাসিরাবাদ এলাকার কিছু তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। তিনি তখন জয় পাহাড়ের একটি বাড়িতে আত্মগোপনে। এদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা বাবুল, রহমান ও আলমের নাম জানা যায়। তারা এনায়েত মওলাকে আবারও অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য অনুরোধ করেন এবং তিনি তাতে সাড়াও দেন। এরপর প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যা আগের মতই বাড়তে থাকে। আর এসব প্রশিক্ষণার্থী মুক্তিযোদ্ধার অনেকের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হয় ‘কাকলী’তে। ‘কাকলী’ ফের পরিণত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে।
অপারেশন জ্যাকপটজুনের শেষ দিকে কাকলীর মালিক এনায়েত মওলার সঙ্গে পরিচয় ঘটে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আনোয়ারের (মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি গুলজার নামে পরিচিত ছিলেন) সঙ্গে। তিনি বাঙালিদের প্রতি সদয় এবং পাকিস্তানি হানাদারদের পাশবিকতার বিরোধী ছিলেন। এনায়েত মওলার বয়ানে লে. কমান্ডার আনোয়ারই প্রথম চট্টগ্রাম বন্দর অচল করে দেয়ার প্রস্তাব দেন। তারা সবাই মিলে একটি পরিকল্পনাও তৈরি করেন। তাদের পরিকল্পনা ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের একটি নির্দিষ্ট চ্যানেলে কয়েকটি সিমেন্ট বোঝাই ট্রলার ডুবিয়ে বন্দর অচল করে দেয়া।
কিন্তু জুলাইয়ের প্রথম দিকে ‘অপারেশন জ্যাকপট’র দুই নৌ কমান্ডো মুক্তিযোদ্ধা আফসার উদ্দিন মো. আলী ও সিদ্দিকুর রহমান জানান, বন্দরে বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা আছে। তাই এনায়েত মওলাদের বন্দর অচল করে দেয়ার পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়। এসময় এনায়েত মওলার প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সহযোগী আজিজুর রহমান নৌ কমান্ডোদের বন্দর এলাকার একটি ম্যাপ তৈরি করে দেন, যা ‘অপারেশন জ্যাকপট’-এ ব্যবহৃত হয়। পরে ওই দুই নৌ কমান্ডোসহ অভিযান দলের বেশ কয়েকজন সদস্য বিভিন্ন সময় ‘কাকলী’তেই অবস্থান করেন।
কিছুদিন পর এনায়েত মওলার উদ্যোগে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার আনোয়ারের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মিলিত হওয়ার আয়োজন করা হয় ‘কাকলী’তে। ওই সাক্ষৎ পর্বে এনায়েত মওলা ছাড়াও ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম, আফসার, সিদ্দিকি, রহমান, আলম, শাহাবুদ্দিন, বাবুল।
‘অপারেশন জ্যাকপট’র মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনীর ২৬টি পণ্য ও সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ ও গানবোট ডুবিয়ে দেন নৌ কমান্ডোরা
আগস্ট মাসের শুরুতে ‘অপারেশন জ্যাকপট’র নৌ কমান্ডোরা চট্টগ্রামে প্রবেশ শুরু করেন। এসময় ‘অপারেশন জ্যাকপট’র দলনেতা সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরীসহ (এ. ডব্লিউ. চৌধুরী) কমপক্ষে ২০ জন নৌ কমান্ডো ‘কাকলী’তে আশ্রয় নেন।
অপারেশনের আগে নাসিরাবাদের ছেলে নৌ কমান্ডো মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলম ইস্টার্ন রিফাইনারির ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমানের সহায়তায় ‘অপারেশন জ্যাকপট’র প্রধান অধিনায়ক এ. ডব্লিউ. চৌধুরী ও শাহ আলমকে ‘কাকলী’ থেকে বেইজ ক্যাম্প ‘সুফিয়া মঞ্জিলে’ পৌঁছে দেন।’
এরপরই ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট রাতে রচিত হয় বাঙালির এক বীরত্বগাঁথা। নৌ-কমান্ডোরা একযোগে চট্টগ্রাম, মোংলা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ বন্দর আক্রমণ করে এবং পাকিস্তান বাহিনীর ২৬টি পণ্য ও সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ ও গানবোট ডুবিয়ে দেয়। দুঃসাহসিক সেই অপারেশন হানাদারদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সেই অপারেশনের কথা ফলাওভাবে প্রচার হয় বিশ্বমিডিয়ায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানতে পারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা।
সম্প্রতি ‘অপারেশন জ্যাকপট’-এ অংশগ্রহণকারী সদস্যদের সংগঠন ‘নেভাল কমান্ডো অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ কর্তৃক প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধা আবু সাইদ সরদার সম্পাদিত ‘অপারেশন জ্যাকপট-চট্টগ্রাম’ থেকে জানা যায়, ‘অপারেশন জ্যাকপট’র দলনেতা এ. ডব্লিউ. চৌধুরী তখন আশ্রয় নিয়েছিলেন ‘কাকলী’তে। ...নৌ কমান্ডো খোরশেদ আলম ইস্টার্ন রিফাইনারির ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমানের সহায়তায় তার স্ত্রী দাওয়াতে যাচ্ছেন এমন এক কাল্পনিক গল্প বানিয়ে এ. ডব্লিউ. চৌধুরী ও ডা. শাহ আলমকে ‘কাকলী’ থেকে অপারেশনের বেইজ ক্যাম্প ‘সুফিয়া মঞ্জিলে’ পৌঁছে দেন।’
মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি তার ‘মুক্তিযুদ্ধে নৌ কমান্ডো’ বইয়ে লিখেছেন, ‘এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, নৌ কমান্ডোদের সার্থক অপারেশন...অপারেশনের সময় যারা সাধ্যমত সাহায্য করেছেন, তাদের মধ্যে সৈয়দ আবু সাইদ সরদার, ....নাসিরাবাদের কাকলীর তাহের, মওলা সাহেব ও তার স্ত্রী, আজিজুর রহমান ও আরও অনেকে আছেন। এদের সকলের সাহায্য-সহযোগিতায় নৌ-কমান্ডো সফল অপারেশন করেছিল।’
অপারেশন জ্যাকপট-২প্রথম অপারেশন সফলভাবে শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় অপারেশনের জন্য সেপ্টেম্বরের দিকে নৌ কমান্ডোদের পরের দলটি আসে। সে দলের নেতৃত্বে ছিলেন কমান্ডার ফারুক। এবারও নৌ কমান্ডোদের একটি গ্রুপ ‘কাকলী’তে আশ্রয় নেয়। কিন্তু প্রথম অপারেশনের পর থেকে জেটিতে খুব কড়াকড়ি ছিল। তাই অপারেশন চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিল। এসময় পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত হয় কর্ণফুলীর মোহনায় গিয়ে এবারের আক্রমণটি হবে। তবে বিভিন্ন কারণে ওই অপারেশনটি ব্যর্থ হয়। হানাদারদের হাতে ধরা পড়ে যান ‘কাকলী’তে আশ্রয় নেয়া নৌ কমান্ডোদের কয়েকজন।
এরপর বাড়িটিতে নেমে আসে বিভীষিকাময় আরও একটি দিন। পাকিস্তানি নৌ বাহিনীর সদস্যরা ‘কাকলী’তে হানা দেয়। এসময় সেখানে থাকা বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাসহ বাড়িটির দ্বিতীয় তলার ভাড়াাটিয়া আশফাক চৌধুরী, কেয়ারটেকার তাহের, নিজাম, আলী তাদের হাতে ধরা পড়েন। পরে অবশ্য আলী, আশফাক ও তাহের মুক্তি পান। তবে অন্যদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা অজানাই থেকে যায়।
এই ঘটনা সম্পর্কে কর্ণফুলীতে দ্বিতীয় কমোন্ডো অভিযানের অধিনায়ক ফারুক-ই-আজম তার ‘এখনও সহযোদ্ধাদের মুখ ভেসে ওঠে’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা কর্ণফুলীতে দ্বিতীয় কমোন্ডো অভিযান। ১৯৭১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ২০ নৌ কমান্ডো নিয়ে আবার চট্টগ্রাম এসেছি। নৌ কমান্ডো অভিযানের সঙ্গে এর আগের সংশ্লিষ্ট সব স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকের পূর্ব পরিচয়ের কারণে দ্রুত আমাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। নাসিরাবাদের কাকলী, আগ্রাবাদের হাজীপাড়া, মাদারবাড়ী, আসকারদীঘির পাড়ে ছালেহ জহুর সাহেবের বাড়িতে একটি নতুন শেল্টারের ব্যবস্থা করেন।’
কয়েক বছর আগেও ওআইএমসিএ নামে একটি বিদ্যালয় পরিচালিত হতো ‘কাকলী’ বাড়িটিতে। সেটি মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে এখন সেখানে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন
বইটিতে আরও বলা হয়েছে, ‘কাকলী’র এনায়েত মওলা সাহেব নিরাপত্তার জন্য তখন সার্সন রোডের একটি ভবনে আত্মগোপন করেছিলেন। সে বাসায় ১৭ এবং ১৮ সেপ্টেম্বর তারিখে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লোকমান গনি, আবু সাঈদ সরদার, চরলক্ষ্যার মো. ইউনুছসহ অন্যান্য সংগঠক বহির্নোঙর আক্রমণের পক্ষে মত দেন।...সেটি পুরোপুরি সফল হয়নি। ...পরের দিন বিকেলের মধ্যেই আমাদের নাসিরাবাদ ‘কাকলী’র শেল্টার রেইড হয়। সেখানে অবস্থানরত কমান্ডো হাশেম, সহযোগী তাহের ও রহমান ধরা পড়েন। ...পরদিন সকালে মওলা সাহেবের কাছে জানতে পারি পতেঙ্গার কামান স্থাপনার কাছে ক্লান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় ধরা পড়েছেন কমান্ডো নুরুল হক, আমির হোসেন এবং এসএন মওলা।’
এনায়েত মওলার বয়ানে জানা যায়, ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর ২১ ডিসেম্বর আবারও ‘কাকলী’তে ফিরে আসে মওলা পরিবার। ফেরেন তাহের-আলীরাও। সেদিন শ’খানেক মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতিতে প্রথমবারের মত ‘কাকলী’তে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন বারবার হানাদারদের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া ‘কাকলী’র কেয়ারটেকার ও মওলা সাহেবের সবসময়ের সঙ্গী আবু তাহের। আর পতাকাটা ছিল ‘কাকলী’র প্রথম শহীদ হাবিবের, যা তিনি ২৫ মার্চ ওই বাড়িতেই উত্তোলন করেছিলেন।
অতঃপর কাকলীতবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চাকরি হারান ‘কাকলী’র মালিক এনায়েত মওলা। এসময় অর্থকষ্টে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের সেই স্মারক ‘কাকলী’ নামের বাড়িটি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন তিনি। পরে নানাবিধ সামাজিক-রাজনৈতিক বিরোধের মুখে দেশত্যাগ করে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এই মহান মানুষটি। সঙ্গে সঙ্গে ‘কাকলী’ হারায় তার নাম-পরিচয়।
গতকাল ১৫ ডিসেম্বর কাকলীর সেই ভূমিতে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকবছর আগেও জরাজীর্ণভাবে দাঁড়িয়ে থাকা ‘কাকলী’ নামের বাড়িটি আর নেই। সেখানে চলছে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ।
এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে এনায়েত মওলা তার বইতে লিখেছিলেন, ‘বাড়ি যারা কিনেছেন নিশ্চয় তাদের অধিকার আছে নাম পরিবর্তনের, তবু একবার নিজেই গিয়ে বলেছিলাম কেন তারা ‘কাকলী’ নামটা ব্যবহার করেন না।... ইতিহাস হয়তো এভাবেই হারিয়ে যায়।’
মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. মাহফুজুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, ‘কাকলী’সহ চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি ও বধ্যভূমি সংরক্ষণে বেশ কয়েকবার জেলা প্রশাসনকে বলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ছোট্ট একটি উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল পাঁচ বছর আগে। কিন্তু পরে সে প্রকল্প আর এগোয়নি।
জানা যায়, ২০১৫ সালের ২ ডিসেম্বর ‘নেভাল কমান্ডো অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রাম বন্দরের আলোচিত ‘অপারেশন জ্যাকপট’ অভিযান সফল করতে ভূমিকা রাখা ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং কমান্ডোদের আশ্রয় দেয়া চারটি বাড়ির মালিককে বন্দরনগরীর একটি হোটেলে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা জানানো হয়।
এছাড়া সংগঠনটির পক্ষ থেকে নৌ কমান্ডোদের সহযোগিতার জন্য চারটি বাড়িতে বীরত্বসূচক নামফলক লাগিয়ে দেয়া হয়। যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ৪৪ বছর পর প্রথমবারের মত কোনো নাগরিক আয়োজন। তবে সময়স্বল্পতার কারণে সেই যাত্রায় ‘কাকলী’কে ওই সম্মান দেয়া যায়নি বলে এই প্রতিবেদককে তখন জানিয়েছিলেন আয়োজনটির অন্যতম সংগঠক ও ‘অপারেশন জ্যাকপট’র বেইজ কমান্ডার প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মইন উদ্দীন খান বাদল।
‘অপারেশন জ্যাকপট’র আরেক বেইজ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হারিস জাগো নিউজকে বলেন, ‘এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি মাত্র কারণেই বাঙালি রুখে দাঁড়াতে পেরেছিল। সেটি হলো অসীম অকুতোভয় গণশক্তি।’
কিন্তু স্বাধীনতার ৪৯ বছর পর এসে এক মর্মান্তিক সত্যের মুখোমুখি বাঙালি জাতি। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ‘কাকলী’ নামের ঐতিহাসিক বাড়িটি সংরক্ষণ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। সে উদ্যোগ নেয়নি কোনো সরকার বা সংস্থা।
এ নিয়ে জাগো নিউজের কাছে হতাশা ব্যক্ত করেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কাকলী ছিল চট্টগ্রামে নৌ-যুদ্ধের ঐতিহাসিক সাক্ষী। গত ৪৯ বছর কেউ এই স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি। সবচেয়ে হতাশার কথা, গত ১২ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও সে উদ্যোগ নেয়া হয়নি; কারণ এসব উন্নয়নে কমিশন নেই। অথচ একটি স্মৃতিফলক করতে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা প্রয়োজন।’
এ বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে বধ্যভূমি, সম্মুখযুদ্ধের স্থান, এরপর যে বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা থাকতেন ওই বাড়ির সামনে ছোট করে নামফলক দেয়া অথবা চিহ্ন করার জন্য আমরা জেলা প্রশাসনকে একটি তালিকা দিয়েছিলাম। কিন্তু সেগুলোর একটিও হয়নি। নাথপাড়ার বধ্যভূমিতে যে স্মৃতিচিহ্ন আছে সেটিও আমরা কয়েকজন উদ্যোগ নিয়ে তৈরি করেছিলাম। অথচ সরকারের স্ব-উদ্যোগেই এসব সংরক্ষণ করার কথা ছিল।’
আবু আজাদ/এমএইচআর/এইচএ/এমএস